ইসরায়েল দুঃস্বপ্নের কাল ডেকে আনছে by অ্যান মেরি স্লটার

অ্যান মেরি স্লটার
যুক্তরাষ্ট্রে বছরের পর বছর ধরে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালনাজনিত মৃত্যুর হার কমানোর জন্য ব্যাপক চেষ্টার ফলে সেখানে ইদানীং এক মন্ত্র শোনা যায়, ‘বন্ধুরা বন্ধুদের মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালাতে দিতে পারে না’। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর বিশ্বজুড়ে দেশটির বন্ধুদের উচিত সে রকম একটি স্লোগান দেওয়া: ‘বন্ধুরা বন্ধুদের অন্ধভাবে শাসন করতে দিতে পারে না’।
ইসরায়েলের অন্ধত্ব স্ব-আরোপিত। ফিলিস্তিনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ইসরায়েল নিজের মতো করে সমাধান করতে পারে না, ফলে সে এমনভাবে আচরণ করছে যে মনে হয় এই দ্বন্দ্বের কোনো অস্তিত্বই নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে যে বক্তৃতা দেন, তাতে ইরান যে ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে, সে কথা থাকলেও ফিলিস্তিনের জনগণ সম্পর্কে একটি কথাও সেখানে ছিল না। দেশে প্রচারণা চালানোর সময় যে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে, তাদের সম্পর্কে কথা বললেও অন্য ফিলিস্তিনিরা শান্তির যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি।
ইসরায়েলি ভোটাররা সম্ভাবনার রাজনীতির জায়গায় ভয়ের রাজনীতিই বেছে নিয়েছেন। ডানপন্থী ও মধ্যবামপন্থীদের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়ার ব্যাপারটা বন্দুক ও মাখনের এবং নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার মতো ব্যাপার। জায়নবাদী ইউনিয়ন হচ্ছে নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টির প্রধান প্রতিপক্ষ। তারা গৃহায়ণ, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় ও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। ইরান, ইসলামিক স্টেট ও হামাস যে ইসরায়েলের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে, নেতানিয়াহু সে কথা বলেছেন। নির্বাচনের দিন এই ভয়ের কারবারে তিনি বর্ণবাদী মাত্রা যোগ করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আরব ভোটাররা পশুর পালের মতো ভোট দিতে আসছে।’ নির্বাচনী প্রচারণার সময় নেতানিয়াহু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিবাদ মেটানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাঁর সরকারের আমলে এমন কিছু হবে না। ইসরায়েলের অনলাইন সংবাদমাধ্যমের একজন সাক্ষাৎকারগ্রাহক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি এমন কথা বলছেন যে আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে না?’ উত্তরে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ঠিক।’
আর জয়লাভ নিশ্চিত হওয়ার পর নেতানিয়াহু তৎক্ষণাৎ এই বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেন। তিনি দাবি করেন যে শুধু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটা হওয়া সম্ভব নয়, এ কথাই তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তাঁর দাবি, যত দিন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ হামাসের সঙ্গে সখ্য বজায় রাখছে বা যত দিন খালি হওয়া ভূখণ্ডে ‘জঙ্গি ইসলামের উত্থান’ হচ্ছে, তত দিন এটা হওয়া সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু ব্যাখ্যা দেওয়ার সময় শেষ। ফিলিস্তিনিরা বহুদিন ধরে যা অনুমান করে আসছিল, সেটা তারা পরিষ্কারভাবে শুনেছে: শান্তি সমঝোতায় আসার ক্ষেত্রে ইসরায়েলি সরকারের কোনো ইচ্ছাই নেই। তারা বসতি স্থাপন করতেই থাকবে, আর নিরাপত্তা দেয়ালের পেছনে উবু হয়ে বসে থাকবে। এটা বিয়োগান্ত ব্যাপার। কারণ, এতে উভয় পক্ষই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এক চক্করের মধ্যে পড়ে যাবে, আর তাতে দ্বিজাতিভিত্তিক সমাধানের ব্যাপারটি অসম্ভব হয়ে পড়বে। যে সমাধানে দুই পক্ষকেই কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছাড় দিতে হবে, যেখানে ব্যাপারটা এমন যে উভয় পক্ষই আরও বেশি বেশি চায়।
ইসরায়েল এখন তিনটি পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, সব কটিই খারাপ। একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি এবং ইসরায়েলের সবচেয়ে কট্টর সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থক যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনের রাজনৈতিকীকরণ। আজকের মার্কিন তরুণেরা তো আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিধনযজ্ঞ দেখেনি, ফলে আগের প্রজন্ম যেভাবে সাধারণভাবেই ইসরায়েলকে সমর্থন করত, তারা আর সেভাবে তা করে না। ইসরায়েল নিজেকে যেভাবে দেখে, তারা ইসরায়েলকে সেভাবে দেখে না: ইসরায়েল হুমকির মুখে আছে। তাদের কাছে ব্যাপারটি এমন যে একটি ভিন দেশের সরকার রিপাবলিকানদের সঙ্গে খোলাখুলিভাবে সখ্য গড়ে তুলেছে। তারা একসময় প্রশ্ন করতে শুরু করবে, কেন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়, যেখানে তার ঘনিষ্ঠতম ইউরোপীয় মিত্ররা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে?
কংগ্রেসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় নেতানিয়াহু অনেক সমর্থন পেলেও ৬০ জনের বেশি ডেমোক্র্যাট সদস্য সেই বক্তৃতা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইউরোপীয় ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মার্কিনদের সমর্থন হারানো ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য ভালো নয়।
ফিলিস্তিনিরা এখন আরও সংকল্প ও জোশের সঙ্গে একপক্ষীয় স্বীকৃতির মাধ্যমে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হবে। তারা সফল হলে ইসরায়েলের সামনে এমন এক ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটবে, যার সীমানার সঙ্গে তারা একমত নয়। আর চলমান দ্বন্দ্ব দুই দেশের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে রূপ নেবে, আন্তর্জাতিক আইনের পরিসরের মধ্যে।
ব্যর্থ হলে ফিলিস্তিনিরা আবারও সহিংসতার পথে হাঁটবে, তৃতীয় ইন্তিফাদা। তবে প্রথম দুটির তুলনায় এই তৃতীয় ইন্তিফাদার আন্তর্জাতিক সমর্থন অনেক বেশি হবে। সে ক্ষেত্রে সম্প্রতি গাজা যুদ্ধে ইসরায়েল যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, সে রকম কিছু করা ছাড়া ইসরায়েলের আর কিছু করার থাকবে না। যে যুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম মৃত শিশুর ছবি, ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল ও কলেজের ছবিতে ভরে গিয়েছিল। এমনকি ইসরায়েলি সেনারা পাথর নিক্ষেপরত ফিলিস্তিনি বালকদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে, তেমন ছবিও আমরা সে সময় দেখেছি। ইসরায়েল ও তার বন্ধুরা নিশ্চয়ই আবারও সেই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে চাইবে না।
নেতানিয়াহু ভাবেন, তিনি দেয়াল বানাবেন আর সব সমস্যা চিরতরে মিটে যাবে। কিন্তু ল্যাংস্টন হিউজের কবিতার বিখ্যাত কয়েকটি কথা মাথায় রাখা দরকার, যেটা মার্কিন নাগরিক আন্দোলনের ধ্রুবকে পরিণত হয়েছিল:
‘তামাদি স্বপ্নের কী দশা হয়?
এটা কি শুকিয়ে যায়, সূর্যের আলোয় যেমন
কিশমিশ শুকিয়ে যায়, নাকি
ক্ষতের মতো পচে যায়—
তার পর সে কি দৌড়ায়?
নাকি ভারী বস্তুর মতো বেঁকে যায়
অথবা, বিস্ফোরিত হয়?
ইসরায়েলের আগের সব সরকারের আমলেই দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের রাগ-ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলে তারা সেটা বাগে আনতে পারে। কিন্তু যতবারই তারা সেটা করেছে, ইসরায়েলের নৈতিক বল ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। ইসরায়েল এক বিশেষ ও রোমাঞ্চকর দেশ। সেখানে অনেক মেধাবী, পরিশ্রমী ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মানুষ আছে। কিন্তু দেশটির বর্তমান নেতারা ফিলিস্তিনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে এক দুঃস্বপ্নের কাল ডেকে আনছেন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
অ্যান মেরি স্লটার: মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাবেক পলিসি প্ল্যানিং ডিরেক্টর।

No comments

Powered by Blogger.