জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও মোবাইল কোর্ট by আলী ইমাম মজুমদার

সরকারের অনেক অঙ্গ থাকে। এসব অঙ্গ বিভাগ, সংস্থা, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রতিটির ভূমিকা আইনের গণ্ডি বা ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাহী আদেশ দ্বারা নির্ধারিত। সে ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূলত লক্ষ্য জনস্বার্থ। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গ যথাযথ ভূমিকা রাখতে সময়ে সময়ে অধিকতর ক্ষমতায়নের প্রয়োজন অনুভব করে। দাবি জানায় সরকারের কাছে। কখনো বা বিভিন্ন অঙ্গের দায়িত্বের পরিসরে পরিবর্তনও আসে। ক্ষেত্রবিশেষে একটি অঙ্গ অপর অঙ্গের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। এ নিয়ে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন বিভাগ বা সংস্থা। এ প্রবণতা শুধু আমাদের দেশে আছে তা-ই নয়, আছে অন্যত্রও। বিশেষ করে একই প্রশাসনিক সংস্কৃতির দেশগুলোতে। কিছুদিন আগে ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারে পরিবর্তন আসার কয়েক মাস পর নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তির্যক মন্তব্য করেছিলেন; বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার পারস্পরিক কোন্দল এতটা তীব্র যে পারলে তারা আদালতে যেত।
দুর্বল প্রশাসনিক পরিকাঠামো আমাদের দেশে। সদা রাজনৈতিক কলহ-কোন্দলের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনগণের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে শক্ত ভিত দেওয়া যায়নি। নিয়োগ, পদোন্নতি, পদ সৃষ্টি ইত্যাদি অনেক কিছুই হয় অ্যাডহক চিন্তাভাবনা থেকে। তাই এগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার অভাবও কিছুটা বেশি বটে। কেউ কেউ ভাবেন, অপর একটি সংস্থার ক্ষমতা তঁাদের দেওয়া হলে অধিকতর কার্যকর অবদান রাখা যেত। এসব ভাবনা বা দাবির পেছনে শুধু গোষ্ঠীস্বার্থ কাজ করছে, এমনটি বলা সংগত হবে না। নিজস্ব উপলব্ধি থেকে প্রশাসনকে অধিকতর কার্যকর করার জন্য তা আসতে পারে। দাবি এলে দেখা দরকার, প্রচলিত ব্যবস্থা কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করছে কি না, আর তা কীভাবে প্রতিকার করা সম্ভব।
ঠিক তেমনই কিছু দাবিদাওয়া এসেছে সম্প্রতি শেষ হওয়া পুলিশ সপ্তাহে। এর বেশির ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক। লোকবল, সরঞ্জাম ও সুবিধাদি বৃদ্ধিসংক্রান্ত। দু-একটি বিষয় আন্তবিভাগীয় সম্পর্কের পারস্পরিক অবস্থান নিয়েও রয়েছে। যেমন: দাবি এসেছে, যেহেতু ‘এসপি জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী’, সেহেতু তাঁদের জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি করা হোক। তেমনই আরেকটি দাবি, প্রতিটি জেলায় আইনশৃঙ্খলাজনিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য এসপিদের অধীনে দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ন্যস্ত করা হোক। এসব দাবিদাওয়া মুক্ত আলোচনাকালে হয়। বিভিন্ন কর্মকর্তা বিভিন্ন দাবি করেন। হয়তোবা তেমনি এ দুটো দাবির বিষয় উত্থাপিত হতে পারে। তবে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। তাই যৌক্তিকতা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
প্রথমে আলোচনায় আসতে পারে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি পদে এসপিকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাবটি। এখন এ পদে ডিসি দায়িত্ব পালন করছেন। উল্লেখ করা যায়, এ কমিটি আইনের কোনো অনুশাসনে গঠিত নয়। এর ভিত্তি সরকারের নির্বাহী আদেশ। উল্লেখ্য, জেলার আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রতি মাসে সভায় মিলিত হয়ে থাকেন। সেখানে আলোচিত হয় আইনশৃঙ্খলাজনিত বিদ্যমান পরিস্থিতি। পরামর্শ আসে তার উন্নতি বিধান ও প্রতিকারের।
আইনানুযায়ী জেলার আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে পুলিশ সুপার রয়েছেন, এটা সত্য। ঠিক একই আইনে এ কার্যক্রমে ডিসিরও সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। শুধু পুলিশ আইন বা পুলিশ প্রবিধান নয়, ফৌজদারি কার্যবিধিতে জনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ম্যাজিস্ট্রেটের। বেআইনি জনতা ছত্রভঙ্গ করা থেকে শুরু করে গণ-উপদ্রব দূরীকরণে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রধান দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেটের। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে জেলায় সামরিক বাহিনী তলবের ক্ষমতাও ফৌজদারি কার্যবিধিমতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বের অংশ। আধা সামরিক বাহিনী নিয়োগের বিষয়েও একই সমীকরণ কাজ করে। শুধু পুলিশ আইন বা ফৌজদারি কার্যবিধি নয়, অস্ত্র আইনসহ জনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বহুবিধ আইনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং, সংগতভাবে সব দিক বিবেচনা করে ডিসিকে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি রাখা অযৌক্তিক বলা যাবে না। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যববিধির ১০ ধারায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে জেলার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের প্রধান কর্মকর্তা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরপর আলোচনা করা যেতে পারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য এসপিদের অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট ন্যস্ত করার বিষয়টি। বর্তমানে চলমান এসব আদালতের আইনি উৎস ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইন। এ আইন বিচার বিভাগ পৃথক্করণের পরে জারি করা একটি অধ্যাদেশকে প্রতিস্থাপন করেছে। আইনটির প্রয়োগ ভেজালবিরোধী অভিযান, বাল্যবিবাহ, ইভ টিজিং রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথেষ্ট ফলপ্রসূ বলে প্রশংসিত হচ্ছে। পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ চলাকালে হিংসাশ্রয়ী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য ধৃত অপরাধীদের তাৎক্ষণিক শাস্তি দেওয়ার সুফলও লক্ষণীয় হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে এর অপপ্রয়োগ সমালোচিতও হচ্ছে। তবে বর্তমানে হিংসাশ্রয়ী যে কার্যক্রম চলছে, তা নিবারণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা জোরদার করা যেতে পারে। এসপিরা অনুরোধ করলে এটা করতে কোনো ডিসি অস্বীকৃত হবেন বা ম্যাজিস্ট্রেট দেবেন না, এমন মনে করার সুযোগই নেই। বরং অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই দেওয়ার কথা। ভিন্ন কিছু ঘটলে এসপি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও পারবেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ বিভাগ, ওয়াসা, রাজউক, বিমানবন্দর, সিটি করপোরেশন এমনকি র্যাব জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি কাজ করে না। তাই সেসব সংস্থার কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে সংঘটিত অপরাধের দ্রুত বিচারের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া আছে। তাঁরা প্রয়োজনমতো মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন। ওই সব বিভাগ বা সংস্থা আদালতকে সহায়তা দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে জেলায় কার্যরত সব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধস্তন। সুতরাং, উপরিউক্ত সংস্থাগুলোতে কর্মরতদের অবস্থানও তা-ই। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তাঁদের কাজের তত্ত্বাবধান ও আইনি নির্দেশনা দেওয়ার কথা। এটি একটি দিক। অপর দিকে, ডিসি ও এসপি জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একই উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন। নিত্য তাঁদের যোগাযোগ। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন কাজ করছেন। সুতরাং, সেখানে এসপির অধীনে মোবাইল কোর্টের জন্য পৃথক ম্যাজিস্ট্রেট ন্যস্ত করার প্রস্তাবটি প্রাসঙ্গিক—এমনটা বলার সুযোগ নেই। যেসব বিষয় নিয়ে এ দাবিগুলো, তা পুলিশ বাহিনীর কর্তব্য সম্পাদনে কতটা সহায়ক হবে, এটা বোধগম্য নয়।
কয়েক বছর যাবৎ জেলা প্রশাসন ও পুলিশের মধ্যে সমন্বয়হীনতার বিষয়টি লক্ষণীয় হচ্ছে। আবার এ–ও দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে তারা বেশ গোছালোভাবে মিলেমিশে কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার কী ভূমিকা, এটাই মূল বিতর্কের বিষয়। ডিসিকে বুঝতে হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁরা একটি যুগবাহিত কার্যকর পদ্ধতি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন। এখানে এসপিরও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভূমিকা পালনে তাঁকে সহায়তা করতে হবে ডিসিকে। ঠিক তেমনই আইনে ডিসির যে ভূমিকা রয়েছে, তা পালনে তিনি যেন বাধার সম্মুখীন না হন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এসপির। শাসনব্যবস্থার ভারসাম্য রাখার জন্যই এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অবশ্য আইন অলঙ্ঘনীয় দলিল নয়। প্রয়োজনে এর সংশোধন হবে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পুলিশের কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব উপমহাদেশে শাসনব্যবস্থার ঐতিহ্য। ভারত এটাকে জোরদার করেছে।
পক্ষান্তরে, পাকিস্তান ভিন্ন একটি আইন করে এটা কার্যত রদ করেছে। বলা হয়ে থাকে, এটাসহ এ ধরনের বেশ কিছু কারণে সে দেশে কার্যকর বেসামরিক শাসনব্যবস্থা একরূপ নেই বললেই চলে। পাশ্চাত্যে যেখানে শাসনব্যবস্থা ভিন্ন ধরনের, সেখানে পুলিশ স্থানীয়ভাবে নিয়োগকৃত এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ। আদালত আর নিজেদের বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ তো রয়েছেই। প্রকৃতপক্ষে, কাউকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করা সুশাসনের পরিপন্থী। যার যত ক্ষমতা, তার ওপর সে অনুপাতে রাখতে হবে নিয়ন্ত্রণ। শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষার্থে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এর বিকল্প নেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.