অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেত- রফতানি কমছে ; বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি ; বিনিয়োগেও নেই সুখবর by আশরাফুল ইসলাম

রাজনৈতিক সঙ্কট দেশের স্থবির অর্থনীতিকে আরো স্থবির করে তুলছে। অশনি সঙ্কেত বয়ে আনছে দেশের অর্থনীতিতে। সদ্য ঘোষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতেও এ অশনি সঙ্কেতের চিত্র ফুটে উঠেছে। রফতানি আয় কমছে, কিন্তু সেই হারে আমদানি ব্যয় কমছে না। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। মুদ্রানীতিতে আগামী জুনে বাণিজ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে বলে আগাম ধারণা দেয়া হয়েছে। দেশে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের বেতনভাতা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেবা খাতের আয়-ব্যয়ের পার্থক্যও অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। ফলে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা চলতি হিসাবের ভারসাম্য ইতিবাচক সূচক থেকে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগেও কোনো সুখবর নেই। জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির অনুপাতে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এতে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে চলেছে। কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ব্যাংকিং সেক্টরেও নগদ আদায় কমে গেছে। গোঁজামিল দিয়ে বড় বড় ঋণখেলাপিকে ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সব মিলে চলমান সঙ্কট দ্রুত সমাধান না হলে সামাজিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে : আগামী ছয় মাসের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে জুন শেষে বাণিজ্য ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৯৯১ কোটি ডলার, যা আগের জুনে ছিল ৬৮০ কোটি ডলার। জুন শেষে বাণিজ্য ঘাটতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা মূলত ৮ শতাংশ রফতানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে। যেমনÑ আগামী জুনে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তিন হাজার ২১৪ কোটি ডলার। কিন্তু বাস্তবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। এ সংশয়ের কারণ হলো গত কয়েক মাসের রফতানি আয়ের চিত্র। আমদানি-রফতানিতে জুলাই-নভেম্বরকে ভিত্তি হিসেবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আলোচ্য পাঁচ মাসে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ। কিন্তু এ সময়ে আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। আমদানি-রফতানির এ সূচক ছিল ওই সময়ের, যখন দেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন হরতাল-অবরোধ ছিল না। কিন্তু গত ৫ জানুয়ারি থেকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি নিয়ে হরতাল-অবরোধ শুরু হয়েছে। বেড়ে গেছে রাজনৈতিক সঙ্কট। বিদেশী ক্রেতাদের নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে পারছেন না রফতানিকারকেরা। এমনিতেই বিদ্যুৎ-গ্যাস সঙ্কট কাটেনি। সামনে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির খড়গ ঝুলছে সব শ্রেণীর গ্রাহকের ওপর। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়ে যাবে। সব মিলে আগামী জুন শেষে রফতানি আয়ের ৮ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে অনিশ্চয়তাই থেকেই যাচ্ছে। আর রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলে বাণিজ্য ঘাটতি মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাড়ছে বিদেশীদের বেতনভাতা ব্যয় : বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতি অনুযায়ী সেবা খাতে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৫৬১ কোটি ডলার। এ সময়ে সেবা খাতে বিদেশী নাগরিকদের বেতনভাতা পরিশোধ দেখানো হয়েছে ৮৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলার আর বাংলাদেশে সেবা খাতে আয় দেখানো হয়েছে ৩১০ কোটি ডলার। অথচ গত জুনে প্রবাসী নাগরিকদের বেতনভাতা পরিশোধ করা হয়েছিল ৭২৫ কোটি ডলার আর সেবা খাতে আয় হয়েছিল ৩০৬ কোটি ডলার। আগামী জুনে প্রাইমারি আয়-ব্যয়ের ব্যবধানও দেখানো হয়েছে ঋণাত্মক ২৮৩ কোটি ডলার, যা আগের বছরে ছিল ২৫৭ কোটি ডলার।
ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্য : এক দিকে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, বাড়ছে সেবা ও প্রাইমারি খাতে আয়ের ঘাটতি। সব মিলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য দীর্ঘ দিন পর ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে আগামী জুন শেষে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ঋণাত্মক প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার, যা গত জুনে ছিল প্রায় ১৩৫ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত। তবে আগামী জুনে চলতি হিসাবের এ ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন; কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রফতানি আয় হবে না। এতে বাণিজ্য ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় সেবা খাতের আয়ও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে, কারণ দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় যারা বিদেশে সেবা বিক্রি করেন তাদের পারিশ্রমিক অনেক সময় আনতে চান না। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধান না হলে সেবা খাতে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি আরো বেড়ে যাবে। তখন সামগ্রিকভাবেই চলতি হিসাবের ভারসাম্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ঋণাত্মক হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকলে নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৪৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। এরপর গত দুই অর্থবছরে কখনো ঘাটতি দেখা যায়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছর শেষে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত দাঁড়ায় ২৫২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ওই সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট, ঋণ কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন কারণে বিনিয়োগে মন্দাভাব থাকায় কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ হয়নি। বর্তমানেও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত না হলেও তহবিল ভিন্ন খাতে ব্যবহারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চলমান সঙ্কটে এ ঘাটতি আরো বাড়লে ভবিষ্যতে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়ে তা রিজার্ভে চাপ বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির ওপরও প্রভাব ফেলবে।
এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতিতে বিনিয়োগসহ অর্থনীতির কোনো সুখবর দিতে পারেনি, বরং চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রবৃদ্ধিতে কালো মেঘের ছায়া দেখছে। গত ২৯ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আতিউর রহমান রাজনৈতিক সঙ্কট দ্রুত না কাটলে কাক্সিক্ষত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না বলে আশঙ্কা করেন। তিনি বলেছেন, শুধু তা-ই নয়, আগামী ছয় মাসের জন্য ঘোষিত আগাম মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জও এ রাজনৈতিক সঙ্কট। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনায় ছায়া ফেলেছে। দেশের অর্থনীতির দিক চিন্তা করে সবাইকে দ্রুত সঙ্কট উত্তরণের আহ্বান জানান তিনি।
এ দিকে ব্যাংকিং খাতের চিত্রও ভালো নয়। গত পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে বিভিন্ন উপায়ে টাকা বের করে নেয়া হয়েছে, যা কখনো ছিল না। ঋণের নামে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ভুয়া জামানত দিয়ে ঋণ নেয়ায় এ অর্থও এখন আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য নগদ আদায় ছাড়াই এর আগে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হয়। এতে খেলাপি ঋণের চিত্র কৃত্রিমভাবে কমে যায়। এখন আবার বড় গ্রাহক অর্থাৎ ৫০০ কোটি টাকার ওপর ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার জন্য ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সুদের হারও কমানো হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকিং খাতে নগদ আদায় কমে যাচ্ছে। সেই সাথে সুদের হার কমে যাওয়ায় আমানতও কমছে। এতে কমছে ব্যাংকের নিট আয়সহ বিনিয়োগ সক্ষমতা।
বিশ্লেষকদের মতে, এমনিতেই চলমান আন্দোলনে পণ্য সরবরাহ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বিনিয়োগ স্থবিরতায় বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এর ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে চলছে। রাজনৈতিক সঙ্কট দ্রুত সমাধান না হলে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরো কমে যাবে, যা দেশকে সামাজিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে। পরিস্থিতি উত্তরণে দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান চান তারা।

No comments

Powered by Blogger.