গণতান্ত্রিক বিচ্ছেদ অথবা জোড়াতালির অখণ্ডতা! by কামাল আহমেদ

বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে বিদেশি কোনো সরকার বা প্রতিষ্ঠানের মতামত বা মন্তব্যের বিষয়ে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদাবোধটা যে খুব টনটনে, তা প্রায়ই বেশ দৃষ্টিকটুভাবে আমরা প্রকাশ করে থাকি। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া মিশেল বার্নিকট কংগ্রেস কমিটিতে তাঁর নিয়োগসম্পর্কিত শুনানিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে মূল্যায়ন তুলে ধরেছিলেন, তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের অনেকের বক্তব্যই ছিল কূটনৈতিক শালীনতাবিবর্জিত। আবার গণমাধ্যমে সরকার-সমর্থকদের কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে ‘বিএনপির স্থায়ী কমিটির বিদেশি সদস্য’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তবে বিদেশি কারও প্রশংসা পেলে সেটার জন্য ঢাকঢোল ভাড়া করায় যে তাঁরা কখনো পিছিয়ে থেকেছেন, এমনটি দাবি করারও কোনো সুযোগ নেই। বিদেশিদের কথায় আমাদের সম্পর্কে কোনো সমালোচনা থাকলে আমরা অনেকেই তাকে সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখাতে চাই। যদিও তার কারণটা মূলত রাজনৈতিক।

কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ধারণায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটছে, তার এক নতুন দৃষ্টান্ত হতে পারে যুক্তরাজ্য। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে আগামী বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) যে গণভোট অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে আগ্রহ ও ঔৎসুক্যের সীমা নেই। অনেকে উদ্বিগ্ন—এমনকি খোদ ইংলিশদের চেয়েও বেশি—মূলত এর রেশ যদি সাতসাগরের নানা পাড়ে আছড়ে পড়ে, সেই আশঙ্কায়। সাবেক উপনিবেশগুলোর জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে অনেকেই যে যুক্তরাজ্যের এই সম্ভাব্য ভাঙন বা বিচ্ছেদে কিছুটা পুলকিত হবেন, তাতেও সন্দেহ নেই। তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় হচ্ছে স্কটিশদের এই স্বাধীনতার বিতর্কে বিদেশি রাজনীতিকদের নাক গলানোর বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামা। তিনি গত জুনে ব্রাসেলসে খোলাখুলিভাবে বলেছিলেন যে যুক্তরাজ্য ঐক্যবদ্ধ থাকলে বিশ্ব লাভবান হবে (দ্য টেলিগ্রাফ, ৫ জুন, ২০১৪)। অবশ্য জনমত জরিপে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার সম্ভাবনা জোরদার হওয়ার পর ওবামা প্রশাসনের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মেরি হার্প বলেছেন, স্কটল্যান্ডের গণভোট ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ বিষয়।
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিতর্কে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন অবশ্য যুক্তরাজ্যের কয়েকটি ইউরোপীয় প্রতেবেশী। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও স্কটিশদের স্বাধীনতাকে নিরুৎসাহিত করার একটা সমন্বিত চেষ্টা প্রত্যক্ষ করা গেছে। স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের সময় স্কটিশ জাতীয়তাবাদীরা ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অংশীদার হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করামাত্রই ইংলিশ রাজনীতিকদের যাঁরা ইউরোপীয় সংহতির বিরুদ্ধে, তাঁরাও বলতে শুরু করেন যে স্কটল্যান্ড আপনাআপনি ইইউর সদস্যপদ পাবে না। ওই বক্তব্যের সমর্থনে তখন এগিয়ে আসেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান ম্যানুয়েল বারোসো। তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্কটল্যান্ডের উত্তরাধিকার সূত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন যে দেশটিকে নতুন করে আবেদন করতে হবে এবং সব সদস্যরাষ্ট্র রাজি হলে প্রয়োজনীয় শর্তগুলো পূরণ করেই তাদের ওই জোটের সদস্যপদ পেতে হবে।
ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে স্কটল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন সম্ভবত স্পেনের প্রধানমন্ত্রী রাহই। বার্সেলোনার দৈনিক লা ভ্যানগার্ডিয়া ইতিমধ্যে ক্যাটালোনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্কটিশদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে বলেছে। হাঙ্গেরির বাণিজ্য–সংক্রান্ত অনলাইন পত্রিকা পোর্টফোলিও স্কটিশদের স্বাধীনতার ধাক্কা ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে আঘাত হানতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। পত্রিকাটি বলছে, শুধু ক্যাটালোনিয়া নয়, বাস্কদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলনও প্রাণ ফিরে পাবে।
ইউরোপের বাইরেও এই গণভোট নিয়ে আগ্রহের কোনো কমতি নেই। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ৮ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে তাঁর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে স্কটিশ গণভোট সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে ‘ঈশ্বর না করুন’ (গড ফরবিড) বলে মন্তব্য করে কিছুটা বিতর্কের জন্ম দেন। ইউরোপ এবং ইউরোপের বাইরে যেসব দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের অস্তিত্ব রয়েছে, তাদের জন্য গণতান্ত্রিক বিচ্ছেদের এই প্রক্রিয়া নতুন করে উদ্বেগের মাত্রা যে বাড়িয়ে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাশিয়া ও চীন সরকারিভাবে কিছু না বললেও তাদের নেতারা যে কিছুটা পুলকিত অনুভব করছেন, তার ইঙ্গিত মিলছে সেখানকার গণমাধ্যমের মন্তব্যে। রাশিয়ার ইজভেস্তিয়া অনেকটা খোঁচা দিয়ে বলেছে, স্কটল্যান্ড আলাদা হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত অবসান ঘটবে এবং সম্ভবত উত্তর আয়ারল্যান্ড একই পথ অনুসরণ করবে। চীনা সংবাদপত্রে বলা হয়েছে যে স্কটল্যান্ডহীন ব্রিটেন দ্বিতীয় সারির দেশে পরিণত হবে। বেইজিং ডেইলি অভিযোগ করেছে দ্বৈতনীতি অনুসরণের। পত্রিকাটি বলছে যে নিজের দেশকে তারা ঐক্যবদ্ধ রাখতে চায়, অথচ তিব্বত ও তাইওয়ানের প্রশ্নে তাদের অবস্থান তার উল্টো।
স্কটিশ এই গণভোট এক অর্থে সম্পূর্ণ নতুন এক পরীক্ষা। প্রথমত, এই গণভোট হচ্ছে ব্রিটিশ সরকার ও স্কটিশ প্রাদেশিক সরকারের মধ্যকার এক সমঝোতার আলোকে। এখানে জাতিসংঘ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো কোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো ভূমিকা নেই। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশ সরকার দুই দফায় গণভোট করে স্কটল্যান্ডকে বিভিন্ন মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার পরও তা যে স্কটিশদের সর্ববিষয়ে স্বাধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি, তারই প্রতিফলন ঘটছে এই স্বাধীনতার বিতর্কে। তৃতীয়ত, এই গণভোটে শুধু স্কটিশরাই ভোট দিতে পারবেন। ওয়েলশ, ইংলিশ কিংবা উত্তর আয়ারল্যান্ডের কেউ ভোট দিতে পারবেন না। নতুন এই স্কটিশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা হলেন স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (এসএনপি) নেতা অ্যালেক্স স্যামন্ড। দুই দফায় প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা করে তিনি স্কটল্যান্ডের জনগণের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। স্বায়ত্তশাসিত প্রাদেশিক সরকারের বাজেটে তিনি তাঁর নাগরিকদের জন্য এমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করেছেন, যা ব্রিটেনের বাকি অংশ করতে পারেনি। স্কটল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কটিশ ও ইউরোপীয় ছাত্ররা নিখরচায় অথবা কম পয়সায় পড়ার সুযোগ পেয়ে আসছেন গত কয়েক বছর ধরে। কিন্তু সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্রিটিশ ছাত্রদের পড়ার জন্য ফি দিতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও ব্রিটিশদের যেটুকু পয়সা খরচ করতে হয়, স্কটিশদের তা হয় না। এরপর নর্থ সির তেলসম্পদের ওপর একচ্ছত্র মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে ভবিষ্যতের স্কটল্যান্ড যে একটি প্রগতিশীল কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে রূপ নেবে, মি. স্যামন্ড সে রকমই এক স্বপ্ন দেখাচ্ছেন স্কটিশদের।
স্কটিশদের স্বশাসনের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা যে তাদের বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেবে, সেটা সম্ভবত ব্রিটেনের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ, লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটের নেতারা বুঝতে পারেননি। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে প্রচারণার দায়িত্ব তাই তাঁরা ছেড়ে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় সারির নেতৃত্বের হাতে। কিন্তু গত সপ্তাহের জনমত জরিপে উঠে আসে ভিন্ন চিত্র। ব্রিটিশ রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র ওয়েস্টমিনস্টারকে গ্রাস করে একধরনের অস্থিরতা। তাঁরা যে কতটা ভয় পেয়েছেন, তা তাঁদের কথায় স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা ওয়েস্টমিনস্টারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় সূচি— প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব বাদ দিয়ে একই দিনে ছুটে যান স্কটল্যান্ডে—নিজেরা ভাগ করে নেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। স্কটল্যান্ড হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে প্রায় কনজারভেটিভমুক্ত এলাকা এবং লেবার পার্টির ঘাঁটি। সুতরাং, প্রধানমন্ত্রী সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন যে কনজারভেটিভদের শিক্ষা দিতে তাঁরা যেন যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন না হন। বিরোধী দল লেবার পার্টি স্কটিশদের ইউনিয়ন ত্যাগ না করার অনুরোধ জানাতে ইংলিশদের প্রতি ইংল্যান্ডজুড়ে স্কটল্যান্ডের পতাকা ওড়ানোর আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরও বিরোধী নেতার ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটেও স্কটিশ পতাকা ওড়ায়। ব্রিটিশ রাজনীতিতে সম্প্রতি আলোড়ন সৃষ্টিকারী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজ এই বিতর্কে এমনকি রানির হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। স্পষ্টতই এগুলো ব্রিটিশ রাজনীতিকদের নিজেদের প্রতি আস্থাহীনতারই আলামত।
ব্রিটিশদের জাতীয় পরিচয় এখন রীতিমতো বিলোপ পাওয়ার মুখে। যদি হ্যাঁ ভোট জয়ী হয়, তাহলে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করবে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম গণতান্ত্রিক বিচ্ছেদ। আর যদি না ভোট জয়ী হয়, তাহলে যুক্তরাজ্যের অখণ্ডতায় আস্থাহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মন জয় করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে সে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো এবং তাদের নেতারা। এর ফলে দেশটির রাজনৈতিক মানচিত্রই যে শুধু বদলাবে তা-ই নয়, আদর্শগত অবস্থানও বদলে যেতে পারে। যুক্তরাজ্যের ভোটের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে ঐতিহাসিকভাবে বামপন্থী লেবার ও উদারপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা স্কটল্যান্ডের ভোটের ওপর নির্ভরশীল আর ডানপন্থী কনজারভেটিভদের শক্ত ভিত হচ্ছে ইংল্যান্ড। ফলে স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে ভবিষ্যতে লেবার পার্টির এককভাবে ক্ষমতায় আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। সর্বোপরি, স্বাধীনতার বিতর্ককে ঘিরে যে তিক্ততা বা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যুক্তরাজ্য টিকে গেলেও মোড়কের নিচে তা আদৌ যুক্ত থাকবে কি না সেটাই হবে প্রধান প্রশ্ন।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.