দীর্ঘ বন্যার ঝুঁকিতে সারা দেশ জলাবদ্ধতায় জনদুর্ভোগ

টানা বর্ষণে নদ-নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় সারা দেশ এবার আগাম বন্যা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। নদ-নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে এ বছর বর্ষা মৌসুমের পুরো সময়জুড়ে বাংলাদেশকে বন্যায় ডুবে থাকতে হতে পারে। কারণ দেশের নদ-নদীর ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় উজানের দেশগুলো থেকে ধেয়ে আসা পানি নামতে পারছে না। ফলে দেশের বেশিরভাগ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পানি নেমে যেতে পারলে বন্যার ঝুঁকি এতটা বাড়ত না। বৃষ্টি কমলে এ ঝুঁকি কেটে যাবে। তবে বৃষ্টি কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। সোমবারও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভারী বর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেই সঙ্গে উজানের দেশ ভারত ও চীনের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টিপাত ঘটেছে। বৃষ্টির কারণে দেশবাসীর ভোগান্তি অব্যাহত ছিল গতকালও।

এ সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার বলেন, দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ১২০ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং মেঘনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। সোমবার সকালে সুরমা নদী সুনামগঞ্জে বিপদসীমার ২ সেন্টিমিটার (সেমি) ওপর দিয়ে, মুহুরী নদী পরশুরামে বিপদসীমার সমান, খোয়াই নদী বাল্লাতে বিপদসীমার ৪১ সেমি ওপর, হবিগঞ্জে বিপদসীমার ১২০ সেমি ওপর এবং কংশ নদী জারিয়াজান্জাইলে বিপদসীমার ৬ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দেশের ৮৪টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের ৫৭টি পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে সোমবার। বৃষ্টির প্রকোপ না কমলে দেশের বিভিন্ন জেলায় আগাম বন্যা দেখা দেয়া খুবই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এই প্রকৌশলী।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আগামী তিন দিনে বৃষ্টির প্রকোপ কমার সম্ভাবনা রয়েছে সামান্যই। অধিদফতরের সোমবারের সতর্কবার্তায় বলা হয়, উত্তর বঙ্গোপসাগরে মৌসুমী বায়ু প্রবল থাকার কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরগুলোর ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়া অব্যাহত থাকতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
নাব্যতা সংকট সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক মোঃ শহিদুর রহমান বলেন, নদ-নদীর নাব্য বাড়াতে এবং নদী ভাঙনের প্রকোপ কমানোর জন্য নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা সেসব প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করেছি। প্রধানমন্ত্রীর মেগা ড্রেজিং প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে নদ-নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা আরও বাড়বে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৫৫ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। বিদেশী সহায়তা না পাওয়া গেলে দেশীয় অর্থেই এ প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নিতে হবে।
দেশজুড়ে দুর্ভোগ : বর্ষণের কারণে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে সোমবারও। রাজধানীর শান্তিনগর, শহীদবাগ, খিলগাঁও, গোড়ান, রামপুরা, মহানগর প্রজেক্ট, বাড্ডা এলাকায় সারা দিনই পানিবদ্ধতা ও যানবাহন সংকট লেগে ছিল। এসব এলাকার স্কুল-কলেজগামী শিশু-কিশোর এবং অফিস-আদালত, কল-কারখানাগামী কর্মজীবী মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সারা দিন। দিনের বেশিরভাগ সময় যানজটে স্থবির ছিল রামপুরা-কুড়িল মেইন রোডটি। কেবল এ এলাকাই নয়, মতিঝিল, মালিবাগ মোড়, মৌচাক, মগবাজার, মধুবাগ, নয়াটোলা, এলাকাতেও পানিবদ্ধতার চরম রূপ চোখে পড়েছে সোমবার। এসব এলাকার জনগণের ভোগান্তি বাড়াতে বাড়তি অনুষঙ্গ হিসেবে যোগ হয় রাস্তার দুরবস্থা। বড় বড় গর্ত, খানাখন্দ পেরিয়ে জনগণকে পথ চলতে হয়েছে সোমবার। যানবাহন সংকটের কারণে বেশিরভাগ মানুষই গন্তব্যে অনাকাক্সিক্ষত দেরির শিকার হয়েছেন। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়েও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। সচিবালয়ের ১নং গেটসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ভেতরেও বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। সচিবালয়ের ভেতরে ৭নং ভবনের সামনে এবং ৩নং ভবনের পূর্বপাশে জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। এ কারণে চলাচলের ক্ষেত্রে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্ভোগে পড়েছেন। পানির কারণে অনেকেই ঘুরপথে ভবনগুলোর সংযোগ সেতু দিয়ে চলাচল করছেন।
সোমবার সকাল ৮টার পর চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত কমেছে। তার আগে মধ্যরাতেও ভারী বর্ষণ হয়। পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস রোববার দুপুর ১২টা থেকে সোমবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। বৃষ্টি থামার পর নগরীর বহদ্দারহাট মোড়, কাপাসগোলা, বাদুরতলা, দুই নম্বর গেট, চকবাজার ও বাকলিয়া এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করে। দুপুরের মধ্যে এসব এলাকার পানি নেমে যায়। তবে আগ্রাবাদ এক্সেস সড়ক, হালিশহরের একাংশ এবং বাকলিয়ার দুয়েকটি জায়গায় রাত পর্যন্ত পানি ছিল। যে কারণে ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগে কাটাতে হয়েছে সোমবার দিনটি। জলাবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে প্রকৌশলী রিপন কর্মকার বলেন, রাজধানীর ৪৩টি খালের অধিকাংশই বর্তমানে দখলদারের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় ধুঁকছে। জমে থাকা পানি বের হতে না পারার এটাই মূল কারণ। মূলত দেশজুড়ে পানি নিষ্কাশন খাল ও নালা-নর্দমা দখল করে স্থাপনা গড়ে তোলা এবং পরিকল্পনাবিহীন ড্রেনেজ ব্যবস্থাই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।

No comments

Powered by Blogger.