সার্কাস: ভানুমতির রক্তারক্তি by মাকসুদুল আলম

ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করছি। লোকমুখে শোনা গল্প। হুবহু মনে নেই। তাই উনিশ-বিশ হলে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। বাংলাদেশের কোন একটি শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা বা নেত্রী একরাতে স্বপ্ন দেখছিলেন।
গহীন বনের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে একসময় তিনি এক দরবেশ বাবার দরবার শরীফে এসে হাজির হলেন। একেবারে নুরানী চেহারার ওলি-আউলিয়া সুফি দরবেশ। বাবার কাছে ইহজগতের যা কিছু প্রার্থনা করা যায়, ভাগ্যে তার সবই মেলে। বাংলাদেশের রাজনীতিক হলে সংসদ সদস্য পদ, শুল্কমুক্ত-সুবিধায় নামিদামি গাড়ি, লোভনীয় আলীশান বাড়ি এগুলো আজকাল না চাইলেও পাওয়া যায়। খামাখা দরবেশ বাবার কাছে চাওয়ার মত জিনিস এগুলো নয়। দরবেশ বাবা মুখ খুলে এবার বাংলাদেশের রাজনীতিককে জিগ্যেস করলেন ‘কি চাই তোমার’। সাথে আরও যোগ করলেন ‘সবই পাবে, তবে একটি শর্ত আছে’। তুমি যাই পাবে তার সবই তোমার প্রতিপক্ষ রাজনীতিক দুটো করে পাবে। একটু ভাঙিয়ে সহজ করে বলা যাক। ‘তুমি সোয়া ছয় কিলোমিটারের একটি সেতু হরিলুট করতে পারলে, তোমার প্রতিপক্ষ পারবে দুটো সেতু হরিলুট করতে’। ‘তুমি একবার শাসন ক্ষমতা পেলে, সে পাবে দুবার’ ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলের এই নেতা বা নেত্রী অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর করলেন। ‘দরবেশ বাবা, আমার কোনকিছুর দরকার নেই। আমি আপনার কাছে কিছুই চাই না। আপনি বরং আমার একটি করে চোখ ও কান চিরদিনের জন্য নষ্ট করে দিন। আর আমার প্রতিপক্ষের তা দুটো করে নষ্ট করে দিন। শুধু এটুকুই আমার চাওয়া।

আমাদের প্রতিহিংসা পরায়ণ ও প্রতিশোধের রাজনীতিতে বর্তমানে তুমল উত্তেজনা বিরাজ করছে। দেশীয় টিভি-চ্যানেল ও দৈনিক পত্রিকা গুলোতে প্রতিদিন প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে মানুষ পিটিয়ে মারার জঘন্য ও লোমহর্ষক দৃশ্য। সেগুলো দেখার বা পড়ার আগে এখন নিজের গায়ে চিমটি কাটতে হয়। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আমরাও দরবেশ বাবার কাছে যাচ্ছি, নাকি বাস্তব জগতে আছি তা যাচাই করতে। একসময় সৌদি-আরবে বাংলাদেশী নাগরিকেদের প্রকাশ্যে শিরচ্ছেদের ঘটনা দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছিলাম আমরা। মধ্যযুগীয় এমন বর্বরতাকে ধিক্কার জানিয়েছিলাম আমরা। এখন প্রতিদিন তার চেয়েও ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে হয় আমাদেরকে। সেটি আফ্রিকার কোন দেশ, আফগানিস্তান বা প্যালেস্টাইনের কোন দৃশ্য নয়। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, নিজের নির্বাচনী এলাকায় যেতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানাতে হয় মাননীয় শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্যকে। অত্যাচার, নির্যাতন, দমন-পীড়ন আর একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের দেশ। ২রা এপ্রিল দৈনিক যুগান্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, বিগত তিনমাসে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৭১ জন খুন হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত বিরোধীদলীয় নেতা ও কর্মীদের মুক্তি, দেশটিতে সংঘটিত সাম্প্রতিক সংঘাত-সহিংসতা বন্ধ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন, দলীয় চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয় লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া ও সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ঘন ঘন হরতাল পালন করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। একদিকে চলছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে শাহবাগের আন্দোলন, যার কলকাঠি ক্ষমতাসীন সরকারের হাতে। অন্যদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চসহ ইসলামবিরোধী ব্লগ বন্ধ করা এবং ধর্ম অবমাননাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে সারা দেশ থেকে ঢাকায় এসে একত্রিত হতে যাচ্ছে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনটির ৬ই এপ্রিলের ‘লংমার্চ’ কর্মসূচিকে ভাগে নিতে উঠে পড়ে লেগেছে সরকার। এই লংমার্চ কর্মসূচি প্রতিহত করতে ইতিমধ্যে ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে সেক্টর  কমান্ডার্স ফোরাম, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসলামবিদ্বেষী ও আপত্তিকর লেখালেখির অভিযোগে ইতিমধ্যে আটক করা হয়েছে বেশ কয়েকজন নাস্তিক ব্লগারকে। শাহবাগের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ খেতাবপ্রাপ্ত ব্লগার রাজীব বেঁচে থাকলে একই অপরাধে শাস্তি পেতেন কিনা জানি না। ‘থাবা বাবা’ খ্যাত নাস্তিক ব্লগার রাজীবের জানাজায় ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা। কিছুদিন আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বসে বসে আঙুল না চুষে, রাস্তায় মিছিলকারী দেখলেই গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল প্রশাসন থেকে। সেই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার অভাবেই হোক আর যেভাবেই হোক, কব্জি উড়ে গিয়েছিল এক পুলিশ কর্মকর্তার। রাজশাহী থেকে শুরু করে সারা দেশে মৌলবাদীদের মূল উৎপাটনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে চিরুনি অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন আমাদের বিতর্কিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মন্ত্রীর হুকুমে জামায়াত-শিবির কর্মীদের প্রতি কামান দাগাতে গিয়ে রাইফেলের ট্রিগারে হাত রাখার আগেই জঘন্য হামলার শিকার হয়েছিলেন পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শিক। কর্তব্যরত পুলিশের সেই অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তার মাথা থেঁতলে দিয়েছিল ইসলামী ছাত্রশিবিরের সন্ত্রাসী ও গুন্ডারা। হামলার শিকার পুলিশের এই উপ-পরিদর্শিককে রক্ষা করতে একপাও এগিয়ে আসেনি আশেপাশে থাকা পুলিশ কনস্টেবলরা কিংবা সেখানে মোতায়েনরত বিজিবি সদস্যরাও। রাজধানী ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে হচ্ছে তাকে। এখনকার হরতালের বৈশিষ্ট হলো, হরতাল ডেকে সাথে-সাথেই রেললাইনের স্লিপার খুলে ফেলে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়া হচ্ছে। সারা দেশের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশজুড়ে নাশকতার আশঙ্কায় গ্রামে-গঞ্জেও এখন সর্বত্র আতংক বিরাজ করছে। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে বিদেশীদের হাতে কোন জাদুর কাঠি নেই, বলে জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা। জাদুর কাঠি নেই আমজনতার কাছেও। ঘরে বসে বসে আঙুল চোষা আর টেলিভিশনের পর্দায় মারামারি কাটাকাটি দেখা ছাড়া কাজ নেই এখন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। বাইরে বের হলে আদৌ ঘরে ফেরা হবে কিনা, তার বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা নেই দেশবাসীর। দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ই-মেইলে মতামত জানতে চেয়েছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে। পরদিন তার জবাব পেয়েছি। তার মতে, আমরা এখন আসলে সার্কাস খেলা দেখছি। ভানুমতির ভয়ংকর সার্কাস। যা রক্তে রঞ্জিত করছে প্রতিদিন আমাদেরকে। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই এখন আর নিজেদের মধ্যে সংলাপ চায় না। তার মতে, এই খেলায় একের পর এক চমক আসবে। ভানুমতির ভয়ংকর এই খেলা কখন কোনদিকে মোড় নেবে, তা কেউ বলতে পারবে না। কখন শেষ হবে তা কারও জানা নেই। বন্ধুর মতামতের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছি আমিও। দিনের পর দিন হরতাল, চলমান সহিংসতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য এখন লাটে উঠেছে। বিপর্যস্ত হচ্ছে জনজীবন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিপুল পরিমান টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ। হাতছাড়া হতে চলেছে তৈরী পোশাক শিল্পের বাজার। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় এই খাতের বিনিয়োগ ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অন্যসব দেশে চলে যাচ্ছে। নিরুৎসাহিত হচ্ছে দেশী-বিদেশী তথা সব ধরনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। স্কুল পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা বিঘিœত হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার সময়সূচি বারবার পরিবর্তন করতে হচ্ছে। উদ্বেগ আর উৎ্কন্ঠা বাড়ছে অভিভাবকদের। এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে, সে আলোচনায় গেলে বিতর্ক আজ শেষ হবে না। আমি অবশ্য রাজনীতিকদের পাশাপাশি মুখোশধারী কিছু প্রথম সারির পত্র-পত্রিকা ও সুবিধাবাদী মিডিয়াকেও দোষারুপ করতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ‘পহেলা আলো’ আজ দেশবাসীকে অন্ধকারে ডুবিয়েছে। গভীর আমাবস্যায় নিমজ্জিত হয়েছে সারা বাংলাদেশ। ‘দৈনন্দিন তারা’ সেখানে বাতি জালাতে পারেনি। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রানের উপায় কী? দেশের সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমাদের প্রত্যাশা, ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতারা কথাবার্তায় সংযম হবেন। উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে অহেতুক রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি না করাই ভালো। নতুন একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের দাবি-দাওয়া আদায়ে শান্তিপূর্ণ লংমার্চ হতেই পারে। তাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা দেওয়া উচিত নয়। আবার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বোমাবাজি, গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মত নাশকতাও দেশবাসীর কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তা নিশ্চিত করতে সচেতন থাকতে হবে। এই অভাগা জাতির এমন কঠিন সময়ে সুশীল সমাজের সত্যিকারের নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা সামনে এগিয়ে আসবেন। আমার মত দোষারুপ না করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজবেন। মিডিয়া তাদেরকে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন। তাহলে হয়ত ভানুমতির সে সার্কাস কিছুটা হলেও শান্তিপূর্ণ হতে পারে। রক্তারক্তির ভয়ংকর সার্কাস দেশবাসী আর দেখতে চায় না। ঘরে বসে বসে নিশ্চয় আঙুল চোষার জন্য আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা এই দেশ স্বাধীন করেন নি।
লেখক: জাপান প্রবাসী কলাম লেখক
৪ঠা এপ্রিল ২০১৩, টোকিও

No comments

Powered by Blogger.