নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা টিআইবি’র

সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দলীয় সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সু্‌ষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় মন্তব্য করে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গতকাল  রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা: প্রক্রিয়া ও কাঠামো প্রস্তাবনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাব তুলে ধরেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবি’র নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রথমে স্পিকার দুই জোটের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে ঐকমত্যের সংসদীয় কমিটি গঠন করবেন। উভয় জোট থেকে চার থেকে ছয় জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হবে। সংসদীয় ঐকমত্য কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানসহ বাকি ১০ জন নির্বাচন করবে। অথবা প্রথমে সরকারের জন্য ১০ জন নির্বাচন করবে। পরে তারা আলোচনা করে ওই সরকারের প্রধান কে হবেন, তা নির্বাচন করবেন। নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান বা অন্য সদস্যরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে হতে পারেন, অনির্বাচিতও হতে পারেন অথবা দুইয়ের সমন্বয়েও হতে পারেন। তবে সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে আলোচনায় পৌঁছাতে না পারলে অনধিক ৩ ব্যক্তির তালিকা স্পিকারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করবেন। তখন প্রেসিডেন্ট ওই তালিকা থেকে একজনকে প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করবেন।  প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণু মনোভাবাপন্ন, প্রতিপক্ষ দলের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও আস্থাভাজন ব্যক্তি মনোয়নয়ন দিতে হবে। এই কমিটির ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে টিআইবি। এছাড়া জরিপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিবাচক দিক ও চ্যালেঞ্জ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ইতিবাচক দিক ও চ্যালেঞ্জ বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের পর ৬টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আর একটি অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় সরকারের অধীনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হয়েছে এবং ওই সরকারগুলো তাদের মেয়াদ শান্তিপূর্ণভাবে করতে পেরেছে। কিন্তু ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কোন মহলেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং ওই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের স্বল্প সময়ের মধ্যেই সরে দাঁড়াতে হয়েছে। তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপট এবং দুই ধরনের নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করা হয়েছে টিআইবি’র প্রতিবেদনে।
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে এখন দিশাহারা ভাব। দেশের মানুষ চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়ে গেছে। দিন দিন পরিস্থিতি আমাদের ধৈর্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিতে অন্যরা সুযোগ নিতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের গণতন্ত্র চুক্তিবদ্ধ গণতন্ত্র। রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্ব করা ক্ষমতা আমরা জনগণ দিয়েছি। তাই তাদেরকে আমাদের বাধ্য করতে হবে একটি ফর্মুলা বের করে সমঝোতায় পৌঁছতে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনেক সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সরকারের  দাবির  বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সুলতানা কামাল বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য আছে। যদি নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী থাকে, তাহলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু বিরোধী দল ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করেছে। নির্বাচন কেমন হবে তা নিয়ে অস্পষ্টতার কারণে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। সুশাসনের প্রেক্ষাপট থেকে টিআইবি এই ফর্মুলা দিয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্যই টিআইবি এই ফর্মুলা দিয়েছে। এই ফর্মুলা রাজনৈতিক জোটের কাছে উপস্থাপন করা হবে। তারা এটিও মেনে নিতে পারে। অথবা নতুন ফর্মুলাও দিতে পারে। বর্তমান সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এই প্রস্তাব অবাস্তব কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরাও সবাই সন্দিহান। আমরা আশা করবো, উভয় জোট নিজেদের মধ্যে আনুগত্য নিয়ে একটা পারস্পরিক সমঝোতায় পৌঁছবে। তারা রাজনৈতিক সমঝোতার বাইরে যেতে পারবে না। সঙ্কট সমাধানে দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসানোর ক্ষেত্রে টিআইবি দূতিয়ালি করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দূতিয়ালির প্রয়োজন নেই। সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির কারণে অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন অন্যরা সুযোগ নেয়। আমরা আশা করবো, উভয় জোট নিজেরাই একটা ফর্মুলা বের করে নেবে।
টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মনোভাব থাকলে একটি ফর্মুলা বের করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের গুহারে জেলে নিলে সমঝোতা সুদূর পরাহত হয়ে যায়। তাই টিআইবি একটি অত্যন্ত সুচিন্তিত  ফর্মুলা দিয়েছে।
কমিটি গঠন প্রক্রিয়া: ঐকমত্য কমিটির জন্য মনোনয়ন আহ্বান করবেন স্পিকার। রাজনৈতিক দলগুলো মনোনীত সদস্যদের তালিকা স্পিকারের কাছে হস্তান্তর করবে। সদস্য নির্বাচনের পর স্পিকার প্রথম সভা আহ্বান করবেন। কমিটি কার্যকর থাকাকালীন সকল সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব। একটি সংসদীয় ঐকমত্য কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানসহ অন্য সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া হবে।
ঐকমত্য কমিটির কার্যক্রম: নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানসহ মোট ১১ সদস্যের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য কমিটি কাজ করবে। সরকার প্রধানের ক্ষেত্রে উভয় জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন নির্বাচিত বা অনির্বাচিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবে। এই কমিটি নির্বাচনকালীন সরকারের বাকি ১০ জনের তালিকা চূড়ান্ত করবে। কমিটি সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৩০ দিনের মধ্যে গঠিত হয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্যদের তালিকা প্রস্তুত করবে। যাতে সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সংসদ ভেঙে দিয়ে উক্ত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে পরেন। ঐকমত্য কমিটি আলোচনার মাধ্যমে কমিটির মধ্য থেকে গ্রহণযোগ্য দুইজনকে নির্বাচন করবে যারা যৌথভাবে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা ওই কমিটির মুখপাত্র হিসেবে যে বিষয়গুলো জনস্বার্থে প্রকাশযোগ্য সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। তারা কমিটির সভা আহ্বান করবেন এবং সার্বিক সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটির সভা পরিচালনার ক্ষেত্রে আহ্বায়কদের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে সভাগুলোর সভাপতি নির্ধারিত হবে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে কমিটির কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাবে। কমিটির প্রত্যক সদস্য দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে।
নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার ১০ সদস্যের মনোনয়ন প্রক্রিয়া: সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে টিআইবি। এক. উভয় জোট থেকে সমান সংখ্যক প্রতিনিধি মনোনীত হতে হবে। দুই. বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে মোট প্রাপ্ত ভোটের দলীয় অনুপাতের ভিত্তিতে সদস্য মনোনীত হবেন।
নির্বাচনকালীন সরকারের এখতিয়ার: নির্বাচনকালীন সরকারের মেয়াদ হবে দায়িত্বগ্রহণের দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিন। এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। শুধু গুরুতর প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন অবস্থায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৯০ দিন পর্যন্ত এই সরকারের মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয় বিবেচনা করা যাবে। এই সরকারের কোন সদস্য সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তারা ১০ সংসদে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ওই সংসদের নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত সরকারি কোন প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত হতে পারবেন না। এই সরকার শুধু নির্বাচন সংক্রান্ত ও দৈনন্দিন প্রশাসনিক অপরিহার্য কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত হবে। বড় কোন প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া, কূটনীতি বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া এবং দ্বিপাক্ষিক বা আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক চুক্তি বা বৈদেশিক সাহায্য বিষয়ে কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া থেকে বিরত থাকবে। সরকার প্রধান নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে মন্ত্রণালয় বণ্টনের বিষয়টি নির্ধারণ করবেন। নির্বাচনকালীন সরকার প্রধান সবধরনের প্রভাবের উর্ধ্বে থেকে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের  ক্ষেত্রে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঠিকভাবে পথ প্রদর্শন করবে।
প্রেসিডেন্টের ভূমিকা: ঐকমত্য কমিটি কর্তৃক প্রণীত নির্বাচনকালীন সরকারের সদস্যদের শপথবাক্য
করানোর জন্য প্রধান বিচারপতিকে আহ্বান জানাবেন। নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার  ক্ষেত্রে বিতর্কের সমাধানের প্রয়োজনে সরকারকে পরামর্শ দিবেন। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের কোন সদস্যকে অপসারণ বা অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধানের পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বা জোটকে সরকার গঠনের আহ্বান জানাবেন।
অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ: প্রস্তাবিত কাঠামো ও প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হলে রাজনৈতিক দলগুলো একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নির্বাচন কমিশনের প্রতি সকল দলের আস্থা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকার কাঠামো ও প্রক্রিয়া যদি গৃহীত হয় তবে দশম সংসদ নির্বাচনসহ পরবর্তী নির্বাচনে তা কার্যকর করার জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে।  এক্ষেত্রে গণভোটের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.