যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলছাত্র হত্যাঃ একাকিত্ব ঘাতক বানায় ল্যানজাকে by হুসাইন আজাদ

যৌথ পরিবার কিংবা মা-বাবার মধ্যকার সুসম্পর্ক একজন সন্তানের মনে সবসময় চাঙ্গাভাব বজায় রাখে। যেটা সন্তানের মানসিক বিকাশে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করে। এ ধরনের ইতিবাচক বিকাশ সন্তানকে অনেক বড় ব্যক্তিত্ব অর্জনেও অনুপ্রেরণা যোগায়।
আবার মা-বাবার মধ্যকার সম্পর্কের ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে যখন পৃথিবী বন্ধুহীন হয়ে উঠে তখন জীবন সত্যিই অসহনীয় হয়ে ওঠে। যেমন অসহনীয় হয়ে উঠছিল অ্যাডাম ল্যানজার জন্য।

যে অ্যাডাম ল্যানজা মানসিক চাপ সইতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তারপর আবির্ভূত হয় মানব খুনী দানবরূপে!

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৬০ মাইল উত্তর-পূর্বের শহর  নিউ টাউনের স্যান্ডি হুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নির্মমভাবে গুলি করে ২০ শিশুসহ ২৮ জনকে হত্যা করে ল্যানজা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো ল্যানজা প্রথমে তার মাকে হত্যা করে, তারপর এলোপাতাড়ি গুলি করে নিজেই আত্মহত্যা করে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও দেশটির বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে উদ্বেগজনক কিছু তথ্য।

বিশেষ করে যারা যৌথ পরিবার ভেঙে পৃথক পরিবার গড়ছেন তাদের জন্য। অথবা যারা কাজের বুয়ার কাছে সন্তানকে রেখে চাকরিস্থলে সময় কাটান তাদের জন্য। কিংবা যারা সন্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মা অথবা বাবা থেকে পৃথক হয়ে যান তাদের জন্য।

এসব তথ্য তাদের জন্যও উদ্বেগজনক যারা সন্তানকে বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে আলাদা রাখতে গিয়ে ঘরকুনো করে ফেলেন।

একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, ২০ বছর বয়সী আডাম ল্যানজার কোনো বন্ধু ছিল না! ছিল না ঘনিষ্ঠ কোনো সহপাঠি।

এমনকি তার একসময়ের সহপাঠিরাও খুব ভালভাবে ল্যানজাকে মনে করতে পারছে না।

তবে কয়েকজন ঝাপসা মনে ল্যানজার কিছু চরিত্র বর্ণনা করে গণমাধ্যমের কাছে।

ল্যানজার স্যান্ডি হুক স্কুলেরই এক সহপাঠি জানায়, “যতদূর মনে পড়ে সে পরিপাটি পোশাক পরত এবং যথেষ্ট পরিশ্রমী ছিল। তাছাড়া সে খুবই কম কথা বলতো।“

তদন্ত শেষে আরেকটি সংবাদ সংস্থা জানায়, ল্যানজা কখনোই নিজেকে ক্যামেরার সামনে আনতো না। এমনকি ২০১০ সালের স্কুলের বার্ষিক অ্যালবামেও ল্যানজার কোনো ছবি নেই।

সংবাদ সংস্থা আরও জানায়, বর্তমান প্রজন্ম সামাজিক যোগাযোগে সারাক্ষণ বুঁদ থাকলেও ল্যানজার কোনো ফেসবুক কিংবা টুইটার অ্যাকাউন্ট ছিল না।

তথ্য প্রযুক্তির এ শতাব্দীতে ইন্টানেট জগতে ল্যানজার কোনো ধরনের বিচরণ ছিল না।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি সংবাদ সংস্থা জানায়, অ্যাডাম ল্যানজা তার মায়ের সাথে নিউটাউনের একটি বাড়িতে বাস করতো।

তার মা যে স্কুলে শিক্ষকতা করতেন সেই স্যান্ডি হুক স্কুল থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব ছিল মাত্র আট কিলোমিটার।

নিউটাউনের একটি সংবাদ সংস্থা জানায়, শহরের একটি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তো ল্যানজা। মা তাকে ঐ স্কুল থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন এবং বাড়িতেই তাকে পড়তে বলেন।

কারণ, স্কুলের ঐ শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো ছিল না বলে মনে করতেন ল্যানজার মা।

ল্যানজার একসময়কার সহপাঠি অলিভিয়া ডেভিভো জানায়, “আমি তার সঙ্গে কখনো কাউকে দেখিনি। কেউ তাকে কোনো কাজে সহযোগিতা করছে এমনটিও কখনো চোখে পড়েনি।”

আরেকজন সহপাঠি জানায়, “সে অনেক স্মার্ট একজন ছেলে ছিল। অনন্য মেধাবিও ছিল।”

তবে, ল্যানজার ফুফু মার্শা ল্যানজা বলেন, “ভালবাসা, মা-বাবার আদর-যত্ন পাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল ও।”

প্রতিবেশির উদ্বৃতি দিয়ে একটি প্রাদেশিক সংবাদ সংস্থা জানায়, “ল্যানজার বাবা ২০০৯ সালে তার মাকে ডিভোর্স দিয়ে কানেক্টিকাটের স্টামফোর্ডে চলে যান এবং অন্য আরেকজনকে বিয়ে করেন।

তারপর ল্যানজার মা পরিবারের হাল ধরেন। তবে সেটা ছিল সন্তানদের একা রেখে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করিয়ে।
এ দিকে, স্নাতক শেষ করার পর ল্যানজার বড় ভাই ২৪ বছর বয়সী রায়ান ল্যানজা নিউজার্সির হোবোকেনে চলে যান এবং সেখানে একটি কোম্পানিতে অর্থব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি নেন।”

ল্যানজার ভাই রায়ান জানান, “২০১০ সালের পর থেকে ল্যানজার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ বা সাক্ষাত হয়নি।”

প্রতিবেশিরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান, ল্যানজার মা-বাবার বিভাজন ও ডিভোর্সই দু’সন্তানের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তবে চাকরি পেয়ে রায়ানের একাকিত্ব ঘুচলেও এ আঘাত সহ্য করতে পারেনি ঘরের কোণে বন্ধু ও মা-বাবাহীন জীবন কাটানো ল্যানজা।

অনাকাঙ্ক্ষিত এ ঘটনা আবারও ভাবিয়ে তুলল ছোট পরিবারপ্রেমী অত্যাধুনিক মানুষকে।

মনোবিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণ, সন্তানের মানসিকতার সুষ্ঠু বিকাশে তাকে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দেয়‍ার বিকল্প নেই। ও কী চাইছে, কী বলছে, ওর মনের ভেতরে কী প্রশ্ন সব কিছুরই সমাধান দিতে হবে মা বাবাকে। মা-বাবা যতো সম্ভব ওদের বন্ধু হয়ে যাবেন।

মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, ডে অথবা নাইট কেয়ারের নামে শিশু স্কুলে দিয়ে মা-বাবা থেকে সন্তানদের আলাদা রাখার প্রবণতা দূর করতে হবে।

ভালো বন্ধুর সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ যোগাযোগও শিশুর মানসিকতা চাঙ্গা রাখতে সহযোগিতা করে।

সবুজ পৃথিবী শিশুর রক্তে আর লাল না হোক! শিশুর উচ্ছল হাসিতে আগের মতোই স্বাভাবিক হয়ে উঠুক সুন্দর পৃথিবী!

No comments

Powered by Blogger.