সরকারের ব্যাংক ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াতে পারে

ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ ২০১০-১১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাজেটে বিদেশি সাহায্য পাওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক কম হওয়ায় এ অবস্থা দেখা দিতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়।
চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের শেষ ভাগে এসেই মূলত সরকারকে ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নিতে হচ্ছে। সর্বশেষ গত ৩০ মে পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ব্যাংক-ব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অথচ ২০০৯-১০ অর্থবছরের একই সময়ে নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ঋণাত্মক বা তার আগের বছরের চেয়ে প্রায় সাত হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা কম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, চলতি জুন মাসে সরকার ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে নতুন করে আরও অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেটা হলে জাতীয় বাজেটে অনুমোদিত অর্থের চেয়ে বেশি ঋণ করবে সরকার।
এ বছর ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে সরকারকে নিট ১৫ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছিল জাতীয় সংসদ। সংসদ একই সঙ্গে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে আট হাজার কোটি টাকা ঋণ করারও অনুমোদন দেয়। কিন্তু, সঞ্চয়পত্রে মুনাফার পরিমাণ কম থাকায় বিনিয়োগকারীরা সরকারের কাছে অর্থ খাটাতে অনাগ্রহ দেখিয়েছে। জুলাই-মার্চ সময়কালে এ খাতে সরকারের প্রকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ৩০ মে পর্যন্ত সরকার ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ নিয়েছে, তার মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৭০০ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। এর মধ্যে উপায়-উপকরণ আগাম হচ্ছে এক হাজার কোটি টাকা, ওভারড্রাফট হিসাবে এক হাজার ৬২৮ কোটি এবং ডিভল্ভমেন্ট হিসাবে প্রায় ৬৭ কোটি টাকা।
আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকার নিয়েছে ১৩ হাজার ৫৭৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। তবে এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে সরকারের দুই হাজার ৩২০ কোটি টাকার আমানত জমা রয়েছে। এই আমানত বাদ দিয়েই সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ দেখানো হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, কোনো বেসরকারি খাতের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে ক্ষেত্রবিশেষে গ্রহীতার এফডিআরকে (স্থায়ী আমানত) জামানত হিসাবে দেখানো হয়। কিন্তু, সেসব ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিট ঋণ হিসাব করতে আমানতকে বাদ দেওয়া হয় না। যদিও সরকারের ব্যাংক খাতের নিট ঋণের ক্ষেত্রে আমানতকে বাদ দেখানো হয়।
সাধারণভাবেই বলা হয়, সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ করলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তির পরিমাণ কমে আসে। আর সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন টাকা ছেপে সরকারের চাহিদা মেটাতে হয়। টাকা ছাপালে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
এর আগে ২০০৯-১০ অর্থবছর শেষে ব্যাংক-ব্যবস্থায় সরকারের মোট ঋণের স্থিতি ছিল ৫১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এটি তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় চার হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা কম। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ মে পর্যন্ত মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।
এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকার প্রথম বছরে টাকা খরচের কায়দাটা ঠিক বোঝেনি। কিন্তু, এ বছর খরচের জায়গাটা বের করে ফেলেছে।
চলতি অর্থবছরে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় (এডিপি) ধরা হয়েছিল ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুই দফায় সংশোধন করে ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু, জুলাই-এপ্রিল সময়ে অর্জন হয়েছে ২০ হাজার ৯০৯ কোটি টাকা, যা সংশোধিত এডিপির ৬০ শতাংশ। এখনো প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যয় সরকারের পরিকল্পনায় রয়েছে।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত রোববার জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে জানিয়েছেন, বর্তমান সরকারের দুই বছরে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঋণদানকারী দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪২৫ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের ঋণ ও অনুদান পাওয়া গেছে।
মন্ত্রী জানান, ২০১০-১১ অর্থবছরের মে পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৪৮৪ কোটি ডলারের বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার অঙ্গীকার পাওয়া গেছে। কিন্তু, এপ্রিল পর্যন্ত ১৪০ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে, বর্তমান অর্থবছরেই বিদেশি ঋণের আসল বাবদ ৭৪ কোটি ৪১ লাখ ৬০ হাজার ডলার এবং সুদ বাবদ ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার পরিশোধ হয়েছে।
এসব পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারকে সতর্কতার সঙ্গে এগোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মত হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প নিতে হতে পারে। এগুলো বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি সাহায্য ও বেসরকারি খাতের বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত হওয়া জরুরি। তা না হলে মাঝপথে এগুলো বন্ধ হয়ে পড়তে পারে। অথবা দেশীয় উৎস থেকে অর্থের জোগান দিতে গিয়ে বৈদেশিক লেনদেনে সংকট তৈরি হবে।
বিশ্লেষকেরা বলেন, লেনদেনের ভারসাম্য মাথায় রেখেই আগামী বছর প্রকল্প-পরিকল্পনা করা উচিত হবে। বড় প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রয়োজন আছে, রাজনৈতিক চাহিদাও আছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্পদের জোগানের কথা চিন্তায় রেখেই প্রকল্প করতে হবে। এসব প্রকল্পের অর্থায়নজনিত ঝুঁকি, লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ ও অগ্রাধিকার বিষয়গুলো খুবই জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.