শেয়ারবাজার কারসাজির তদন্ত ও বিচার by ফারুক মঈনউদ্দীন

শেয়ারবাজার বিশ্লেষকদের বহু তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ, সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের নানামুখী মন্তব্য, বাজার নিয়ন্ত্রকদের দোদুল্যমান ভুল-শুদ্ধ বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত—সবকিছুকে নাকচ করে দিয়ে শেয়ারবাজারের যে অধোযাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই পতন এখন পর্যন্ত রোধ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সদ্য গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তকে বাতিল করে আগের নিয়ম পুনর্বহাল করেও বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়নি। পুরোনো নিয়ম পুনর্বহাল, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওয়া নানা ধরনের প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও যখন পতনশীল গতিকে থামানো যায়নি, তখন সংগতভাবেই ধারণা করা যায় যে বাজারে মারাত্মক অনিয়ম কিছু একটা হয়েছিল এবং সেটা হচ্ছে কোনো বিশেষ মহলের কারসাজি। এই কারসাজির বিষয়ে তদন্ত করার জন্য যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তার প্রধান সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে স্বীকার করলেন যে বাজার কারসাজির হোতাদের অনেককে চিহ্নিত করা সম্ভব হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে কি না, সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ আছে। কারণ নৈতিকতা ভঙ্গের জন্য দোষারোপ করা যায়, কিন্তু শাস্তি দেওয়া যায় না। যেমন—এসইসির প্রধানের চাকরির মেয়াদ শেষ হলে তিনি যদি কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইউনিটের প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত হন, সেটা অনৈতিক হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থার বিধান নেই।
পাঠকের মতে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত শেয়ারবাজার কারসাজি নিয়ে যাবতীয় প্রতিবেদন বা নিবন্ধ যেন আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের চাক্ষুষ প্রমাণসাপেক্ষ বিচারের মতো। ধর্ষক কে জানা গেলেও প্রমাণের অভাবে যেমন তার শাস্তি হয় না, তেমনি শেয়ারবাজারের কারসাজি কারা করেছে, সেটা জানা গেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না প্রধানত দুটি কারণে—প্রচলিত আইনের অপ্রতুলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব। তদন্ত কমিটির প্রধানের বক্তব্যের পেছনে এই দুটি কারণই প্রচ্ছন্ন। অভিযোগকারী পাঠকের বক্তব্য মেনে নিয়েও বলতে হয়, শেয়ারবাজার কারসাজির মতো ধর্ষণের ঘটনাও দেশে দেশে যুগে যুগে ঘটে আসছে, কিছু মানুষের এই সহজাত দুষ্কর্ম আইন দিয়ে বন্ধ করা যায়নি, অতএব তার চেয়ে ধর্ষণের শিকার যাতে হতে না হয়, তার জন্য পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়াই শ্রেয়তর।
বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির প্রসঙ্গে আঠারো শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে শেয়ারবাজারে বুদ্বুদ সৃষ্টি এবং বিস্ফোরণের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিচার ও শাস্তির ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ইতিহাসে এটি দক্ষিণ সাগর বুদ্বুদ (সাউথ সি বাবল) নামে পরিচিত। সে সময় ইংল্যান্ডের বিপুল সরকারি দেনার ভার লাঘব করার উদ্দেশ্যে ১৭১১ সালে সরকারিভাবে সাউথ সি কোম্পানি গঠন করা হয়। সে কারণে এই কোম্পানিকে দেওয়া হয় দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনীয় উপনিবেশের সঙ্গে দাসব্যবসা, সোনা-রুপা এবং অন্য সব পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ। এই অনুকূল সুযোগের বিনিময়ে সরকারের প্রায় এক কোটি পাউন্ডের মতো দেনা শোধ করার জন্য কোম্পানির নতুন শেয়ার ছেড়ে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে বার্ষিক ৬ শতাংশ সুদের বিনিময়ে সরকারে এক কোটি পাউন্ডের দেনাকে শেয়ারে রূপান্তর করতে কোম্পানির কোনো বাধা থাকে না। তবে বাড়তি এই সুদের খরচ মেটানোর জন্য সরকারকে মদ, তামাক, রেশমসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর করারোপ করতে হয়।
লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে সোনা-রুপার খনির অনিঃশেষ মজুদের সম্পর্কে বহু জনশ্রুতি থাকায় কোম্পানিটি গঠিত হওয়ার পর থেকেই মানুষের মনে প্রবল আশা-আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি হয়। তার ওপর কোম্পানির ইনসাইডাররা রটায় যে সেসব দেশকে শেয়ার দিলে তাদের একাধিক বন্দরে কোম্পানির প্রবেশাধিকার থাকবে, সেসব দেশে রপ্তানি করলে বিনিময়ে পাওয়া যাবে বিপুল পরিমাণ সোনা আর রুপা। এসব কারণে কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে। অথচ দক্ষিণ সাগরে কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা পরিচালনা করলেও তাদের সাফল্য ছিল সীমিত।
রাজা প্রথম জর্জ কোম্পানির গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর সাধারণ মানুষের আস্থা আরও বেড়ে যায়। এ সময় কোম্পানির মূলধন আরও ২০ লাখ পাউন্ড বাড়িয়ে এক কোটি ২০ লাখ পাউন্ডে উন্নীত করে সেখান থেকে বার্ষিক ৫ শতাংশ সুদে সরকারকে ২০ লাখ পাউন্ড ধার দেওয়ার জন্য পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস হয়। ১৭২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন পার্লামেন্টে কোম্পানির মূলধন বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন এটির শেয়ারের দাম ছিল ১২০ পাউন্ড, বিতর্ক চলার সময় ৪০০ পাউন্ড, আর প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পর দাম উঠে যায় ৫৫০ পাউন্ডে। সরকারি ঋণ অধিগ্রহণ করে তার পরিবর্তে বাজারে শেয়ার বিক্রি করার যে প্রস্তাব ছিল, সেখানে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও দরপত্র দিয়েছিল, কিন্তু সাউথ সি কোম্পানির প্রতি উচ্চপর্যায়ের বিশেষ আশীর্বাদ থাকায় এই কোম্পানিই দায়িত্বটা লাভ করে। তবে এই প্রস্তাব লর্ডস ও কমন্স সভার বিতর্কের সময় প্রস্তাবটির বিরুদ্ধাচরণ করে একমাত্র সদস্য রবার্ট ওয়ালপোল সাবধান করে দিয়েছিলেন যে কোম্পানিটির যাবতীয় কার্যকলাপ অনৈতিক এবং এতে করে দেশের শিল্প-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আর কোম্পানি ব্যর্থ হলে পুরো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে। এতৎসত্ত্বেও গুজব রটিয়ে কোম্পানির শেয়ারের দাম আরও বাড়ানোর প্রয়াস অব্যাহত থাকে। তার ওপর সোর্ড ব্লেড ব্যাংক সাউথ সি কোম্পানির শেয়ার কেনার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করলে উন্মত্ততা আরও চরমে ওঠে।
কোম্পানি মাত্র ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় ইস্যু যখন বাজারে আসে, তখন দাম উঠে গেছে এক হাজার পাউন্ডে। সেই উন্মত্ত সময়ে রাজা থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সবাই শেয়ার কিনতে থাকেন। সাধারণ মানুষ এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজনও সোনাদানা গচ্ছিত রেখে শেয়ার কেনার জন্য ছুটতে থাকলে শহরের ট্রাফিক-ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কোম্পানির চতুর্থ ইস্যু বাজারে ছাড়া হয় এক হাজার ১০০ শতাংশ বেশি দামে।
শেষ পর্যন্ত ১৭২০ সালের সেপ্টেম্বরে এই বুদ্বুদ বিস্ফোরিত হয়। দুই হাজার পাউন্ডের শেয়ারের দাম নেমে আসে ১৫০ পাউন্ডে, এবং ডিসেম্বরে ১২৪ পাউন্ডে। অগণিত বিনিয়োগকারীর অর্থনাশের ফলে বিপর্যস্ত হয় তাঁদের জীবন, এমনকি বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনও ২০ হাজার পাউন্ড হারিয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডের আর্থিক ইতিহাসের বৃহত্তম এই বিপর্যয়ের বিষয়ে তদন্ত করতে যে কমিটি গঠিত হয়, তার প্রতিবেদনে দেখা যায় কোম্পানির খাতাপত্রে প্রচুর ভুয়া এন্ট্রি, টাকার অঙ্ক লেখা থাকলেও শেয়ারহোল্ডারের নাম ফাঁকা, হিসাবের খাতায় কাটাকুটি, পৃষ্ঠা ছেঁড়া, বহু গুরুত্বপূর্ণ দলিল গায়েব, ইস্যু করা হয়েছে অনুমোদিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি শেয়ার, কিন্তু তার বিপরীতে কোনো দাম আদায় করা হয়নি। অবৈধভাবে ইস্যু করা কোম্পানির বহু শেয়ার দেওয়া হয়েছে আইনসভার সদস্যদের উৎকোচ হিসেবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের সূত্র ধরে কোম্পানির পরিচালকদের সংসদে তলব করে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের লাভের টাকা বাজেয়াপ্ত করে আদায় করা হয় সর্বমোট ২০ লাখ পাউন্ড। তবে সামান্য কিছু টাকা রেখে দিতে দেওয়া হয়েছিল, যাতে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে পারেন তাঁরা। এই ছেড়ে দেওয়া অর্থের পরিমাণ অপরাধের গুরুত্বভেদে ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। পরিচালকদের মধ্যে যাঁরা আইনসভার সদস্য কিংবা অন্য উচ্চপদে ছিলেন, তাঁদের বরখাস্ত করে কাউকে কাউকে কারাদণ্ডও দেওয়া হয়।
ইংল্যান্ডের পুঁজিবাজারের এই সাড়া জাগানো ঘটনাটি হয়তো আমাদের বর্তমান বাজার বিপর্যয়ের সঙ্গে হুবহু তুলনীয় নয়, তবে কৃত্রিম বুদ্বুদ সৃষ্টির অপতৎপরতা এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিগত মুনাফা আদায়ের প্রয়াস অভিন্ন। এ ঘটনার তদন্ত এবং বিচার যে নির্মোহভাবে করা হয়েছিল, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেটি হয়তো দুরাশা। তদন্ত কমিটির প্রধানের কিছু বক্তব্য এই আশঙ্কাকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করে। কমিটির তদন্ত কার্যক্রম আদৌ সফল হবে কি না, সেটা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কারসাজির ওপর তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হলেও তার কোনো চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি আজ পর্যন্ত। এবারের তদন্তের ফলাফল যা-ই হোক না কেন, জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার সম্ভাবনার বিষয়েই সন্দেহ প্রকাশ করছে তদন্ত কমিটি নিজেই।
অতএব তদন্ত প্রতিবেদন, বাজার কারসাজির হোতা, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, কারসাজির বিচার ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের আশাবাদী হওয়ার খুব বেশি একটা সুযোগ নেই, বিশেষ করে মূল নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসির বিরুদ্ধেই যেখানে অভিযোগের গুঞ্জন রয়েছে। তদন্ত কমিটিও প্রকারান্তরে সুকৌশলে এসইসির অসহযোগিতার কথা বলেছে। তবে তদন্ত কমিটির প্রধান একটা কথা বলেছেন যে কারসাজির হোতাদের বিচারের আওতায় আনা না গেলেও তাদের মুখোশ উন্মোচন করা যাবে, যাতে তারা সামাজিকভাবে হেয় হয়। সাউথ সি বুদ্বুদ বিস্ফোরণের পর সেই কোম্পানির পরিচালকেরাও পথে বের হলেই গণধিক্কারের সম্মুখীন হতেন, তবে তাঁরা আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হয়ে শাস্তিও পেয়েছিলেন।
বাজার কারসাজির হোতাদের শাস্তির সম্ভাবনা যেহেতু সুদূরপরাহত, সে রকম আইনি বিধানও যেহেতু নেই, দুর্বৃত্তপরায়ণ একটা শ্রেণী সুযোগ পেলে কারসাজির মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই সরল ও অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের পকেট কেটে নিজের ভাগ্য গড়বে—সে কারণেই সাধারণ মানুষকেই পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেভাবে ধর্ষণের শিকার হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকেন নারীরা। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের পরিহার করতে হবে দ্রুততম সময়ে সম্পদশালী হওয়ার লোভ, কারণ এটিকেই কাজে লাগায় কারসাজির কুশীলবেরা। সেই সঙ্গে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভাবতে হবে, একের পর এক কারসাজি করে প্রভাবশালীরা পার পেয়ে গেলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনষ্ট হওয়া আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাজার তথা শিল্পায়নের জন্য মূলধন গঠন-প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে বাজারের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা, পক্ষান্তরে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিধিবদ্ধতা মেনে চলতে হয়, এবং তাদের রয়েছে আইনকানুনের সীমাবদ্ধতা। সুতরাং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বাজারমুখী করতে এবং টিকিয়ে রাখতে হলে সব ধরনের কারসাজি ও অনৈতিক কার্যকলাপ রোধে কার্যকর আইনি বিধান রাখতে হবে, যাতে কেউ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনভিজ্ঞতার সুযোগে আখের গুছিয়ে সরে পড়তে না পারে। সরকার যদি ‘অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী’ না হয়ে কারসাজির হোতাদের আইনের আওতায় আনতে পারে, সেটা হবে সরকার ও দেশের জন্য এক যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ, আমাদের দেশে আইনের প্রয়োগ সব সময় সবলের পক্ষেই থাকে—এই দুর্নাম আমরা ঘোচাতে পারব, সরকারের হবে রাজনৈতিক অর্জন এবং বাজারে ফিরে আসবে গতি ও আস্থা।
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.