বৈদেশিক মুদ্রার বড় রিজার্ভ: সুখের, তবে বোঝারও by আবু আহমেদ

আমাদের তহবিলে এখন ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা জমা আছে। বাংলাদেশ চাইলে এখন বিদেশ থেকে অনেক কিছু কিনতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিদেশি ঋণদাতাদের কাছ থেকে ধার-কর্জ করার প্রয়োজন পড়বে না। তবুও বাংলাদেশ সরকার ধার-কর্জ করার জন্য অতি পেরেশান। কিন্তু কেন?
সেই কেনর উত্তর হলো, বৈদেশিক মুদ্রা তো জমা আছে ব্যক্তিদের থেকে কেনার দরুন। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই তহবিলকে কিনে নিয়েছে। ব্যক্তি ও আমাদের রপ্তানিকারকেরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, তাদের থেকে বিনিময় হারে কিনে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আমাদের অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক হলো বৈদেশিক মুদ্রার একক ক্রেতা ও বিক্রেতা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও এই মুদ্রা কিনতে পারে; তবে কেনার পর একটা পরিমাণ নিজের কাছে রাখতে পারে মাত্র। বাকিটা বিধি অনুযায়ী অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বাজারমূল্যে বেচতে হবে। কেনার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিনে নিতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয় বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবা কিনতে। এ ছাড়া বৈদেশিক দেনা মেটানোর কাজেও এই মুদ্রার প্রয়োজন পড়ে। যেমন, বাংলাদেশ অতীতে বৈদেশিক মুদ্রায় যেসব ঋণ করেছে, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ওই সব ঋণ চুক্তি অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রায় ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু ওই সব ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, সেজন্য বাংলাদেশ সরকারকেই আমাদের বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে ওই ঋণ ফেরত দিতে হয়। সরকার নিজেও আমদানিকারক। যেমন, পেট্রোলিয়াম প্রডাক্টসের ক্ষেত্রে। তারপর লেটার অব ক্রেডিট বা আমদানির ঋণপত্র খুলতে হলে বৈদেশিক মুদ্রা বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কিনতে হবে। কেন বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ চাইছে, সে প্রশ্নের উত্তর হলো, বাংলাদেশ সরকারের যে অর্থের অভাব, যে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা আছে, সেই মুদ্রাকে বাংলাদেশ সরকার চাইলেই নিতে পারবে না। নিতে চাইলে তাকে দেশীয় মুদ্রা টাকায় কিনে নিতে হবে। আর এখানেই সমস্যা। সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে, ট্যাক্স আদায় করে, বন্ড বিক্রি করে যে অর্থ তুলছে, তার চেয়েও সরকারের ব্যয় অনেক বেশি। অর্থনীতির ভাষায়, আমরা এটাকে বলি ঘাটতি বাজেট। এ অবস্থায় সরকার যদি বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ চায়, তাহলে সে তো অর্থটা পেল! যদিও সেই অর্থ ঋণ করে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব ঘোচানোর প্রয়োজন নেই। সহজ কথায়, আজকের দিনে সরকার বিশ্ব ব্যাংক-এডিবি-আইএমএফ থেকে ঋণ করছে নিজের অর্থের অভাব মেটানোর জন্য। তবে এই ঋণেরও বোঝা আছে। সেদিন আমাকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকে ১০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা পড়ে আছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার কেন বাণিজ্যিক সুদে এডিবি থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিচ্ছে? আমি তাঁকে ওপরের কথাগুলো বোঝাতে চাইলাম। আর সুদ সম্বন্ধে বললাম, ওতে কোনো অর্থনীতি নেই, বরং ক্ষতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক যেখানে তার বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলকে বিদেশি বাজারে খাটিয়ে দুই শতাংশের বেশি সুদ পাচ্ছে না, সেখানে আমাদের সরকার কেন পাঁচ শতাংশ সুদে বৈদেশিক মুদ্রায় বাইরে থেকে ঋণ নেবে? আসলে এ ক্ষেত্রে অর্থনীতির বিষয়টা কেউ দেখছে না। দেখলেও সরকার উপায় নেই বোধ করছে। সেই সাংবাদিক আমাকে এও বললেন, সরকারের অর্থের অভাব হলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করলেই তো পারে। আমি উত্তর দিলাম, ঋণতো করছেই। বন্ড বেচে সরকার তো হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। তবে ওই ক্ষেত্রেও সরকারকে উঁচু সুদ দিতে হচ্ছে। আট শতাংশ হারে।
বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পক্ষে ওদের যুক্তি হলো, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যদি ঠিক থাকে, তাহলে পাঁচ শতাংশ সুদ দিয়ে ডলারে বাইরে থেকে ঋণ নিলে তো ভালো। যুক্তি আছে বটে। তবে শঙ্কা হলো, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার যেমন ঠিক থাকবে না, আর ওই অর্থের ব্যবহারই বা সরকার কোথায় করবে? সরকারি খাতে লুটপাটের কথা তো আমরা সবাই জানি। সরকার ঋণ কিনে জাতিকে ঋণী করছে, অন্যদিকে সেই ঋণের সুবিধাভোগী সমাজের গুটিকতক লোক। এজন্যই আমাদের সবার উচিত, সরকারি ঋণের বিরোধিতা করা।
যা হোক, অন্য প্রসঙ্গে আসি। অর্থ ব্যবস্থাপনার মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনারও একটা ব্যাপার আছে বটে। অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রাকে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে না পারে, তাহলে শুধুই অর্থ হারাবে। ধরে নিলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভে সিংহভাগ ডলার ও ডলারে উল্লিখিত সম্পদে রেখে দিল। এখন মার্কিন ডলারের মূল্য যদি ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক জিতবে, না হারবে? অবশ্যই হারবে। মার্কিন ডলারের মূল্য হারানোর বিষয়ে সন্দিহান হয়েই তো সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তাদের রিজার্ভের একটা অংশ ব্যবহার করে স্বর্ণ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজকে যে স্বর্ণের মূল্য ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এর মূল কারণ বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বর্ণের চাহিদা বেড়ে যাওয়া। প্রায় সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এখন ডলার নিয়ে বেকায়দায় আছে। তারা তাদের ধারণকে ইউরো ও স্বর্ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য পথ ছিল, বিদেশে প্রকৃত সম্পদ ধারণ করা। কিন্তু বাংলাদেশের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর পক্ষে আপাতত সেই পথ রুদ্ধ। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে কোনো ব্যবসা করতে অভ্যস্ত নয় এবং বিধিতেও নিষেধ আছে। এই কাজটা করতে হয় ব্যক্তি খাতের মাধ্যমে। অর্থাত্ ব্যক্তি খাতের কাছে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্য করে, ব্যক্তি খাতকেই স্বদেশে ও বিদেশে বিনিয়োগের জন্য উত্সাহ দিতে হয়। ঠিক এ কাজটিই এখন করছে চীন ও ভারত। ভারতীয় অনেক কোম্পানি যে বিদেশে এখন বিলিয়নস অব ডলারের সম্পদের মালিক হয়েছে, সেটা ভারত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়ার কারণেই।
একপর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার অত বড় হস্তান্তর আর দরকার হবে না। ওদের কোম্পানিগুলো বিদেশে আয় করে, বিদেশেই আয়কে বৈদেশিক মুদ্রায় ধারণ করতে পারবে। এভাবে বিদেশে সম্পদ কিনে লাখ লাখ ভারতীয় শেয়ার হোল্ডিংসের মাধ্যমে বিদেশি সম্পদের মালিক হয়েছে। যেসব দেশ বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারকে উদারীকরণ করেছে, ওই সব দেশের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করা অনেক সহজ হয়েছে। ভারতীয় ব্যক্তি খাত এখন বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণও নিচ্ছে, যেটা আমাদের অর্থনীতিতে বিধিনিষেধের কারণে আজও অনেক সীমিত।
আমাদের অর্থনীতিতে বিনিয়োগকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধগুলো আরও শিথিল করতে হবে। আমাদের অর্থনীতিতে মুনাফার হার বেশি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন কাঙ্ক্ষিত স্তরে বিনিয়োগ হচ্ছে না, তার অন্যতম কারণ এই যে আমাদের অর্থনীতি এখনো বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত হতে পারেনি। এই যুক্ত হওয়াটা একতরফা হওয়া উচিত নয়।
এখন বিদেশিরা এসে আমাদের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে আয়কে আবার বৈদেশিক মুদ্রায় বাইরে নিয়ে যেতে পারে। আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য সেই সুযোগটা কি আছে? বৈদেশিক মুদ্রার শুধু মজুদ বাড়তে থাকলে এ মজুদের অপব্যবহার বাড়ারও আশঙ্কা আছে। দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করে অনেকে অর্থকে বাইরে নিতে চাইবে এ কারণে যে বৈদেশিক মুদ্রা তো অতি সহজলভ্য। তাই মুদ্রার ব্যবহারের বিষয়গুলো উদারীকরণের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির ছিদ্রগুলোও আমাদের বন্ধ করতে হবে। শুধু বসে বসে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বড় করতে থাকলে সেটা মুদ্রাস্ফীতিও ঘটাতে পারে।
আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.