বিশ্ব নারী দিবস শতবার্ষিকীর প্রস্তুতি -রোকেয়া দিবস by ফরিদা আখতার

প্রতিবছর ডিসেম্বরের ৯ তারিখ বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে গিয়ে নারী সংগঠন, এনজিও, সরকারের নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়—সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্তত এই দিনটির স্বীকৃতি পাওয়াও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগায়। রোকেয়া পদক দেওয়া হয় বিশিষ্ট নারীদের। সব মিলিয়ে দিবসটি সমাজের সবাইকে মনে করিয়ে দেয়, নারীমুক্তির জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করার মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখা যায়। রোকেয়া সেই দিকটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এবার রোকেয়া দিবস আমার কাছে খুব তাত্পর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। এর কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, আমরা জানি, এই সময়ে বিশ্বে পরিবেশের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা নারীদের জন্য খুবই ভয়াবহ। এমন সংকট মোকাবিলার জন্য নারী সংগঠনগুলো আসলে কতটা তত্পর বা প্রস্তুত আছে, সেটা দেখা দরকার। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, আগামী বছর, অর্থাত্ ২০১০ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ১০০ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও ইতিমধ্যে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। আমার মনে হয়, সামগ্রিকভাবে সবাই মিলে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তুতি আমরা রোকেয়া দিবস থেকেই শুরু করতে পারি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। খুব অল্প সময়, মাত্র ৫২ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু এই অল্প সময়ে এবং হাজার বাধার মধ্যে তিনি এত কাজ করেছেন যে ভাবতে অবাক লাগে। অনেক কাজের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন নারীর অধিকারের কথা বলতে গিয়ে এবং নারীশিক্ষার জন্য যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা তিনি করেছেন, এর জন্য যে সাহসের দরকার, সেটা তিনি দেখিয়ে গেছেন। এই সাহস এখনকার যুগের মেয়েদের মধ্যে, দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, দেখা যায় না। এখন কাজের সুযোগ অনেক বেড়েছে, প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে অনেক, কিন্তু তা সত্ত্বেও সাহসী নারীর সংখ্যা বাড়েনি। অবশ্য বর্তমান সময়ে বাধাবিপত্তির ধরনও পাল্টেছে। কখনো বলা যায়, অনেক কঠিন এবং অদৃশ্য হয়ে পড়েছে, তাই মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। কিন্তু তবুও পুরুষতন্ত্র যে রূপেই হাজির হোক, তা মোকাবিলা করতে হবে। সাহস না থাকলে তো কোনো কিছুই করা যাবে না। বেগম রোকেয়ার কাছে যে বিষয়টা আমাদের সবার আগে শেখার আছে, তা হচ্ছে সাহসী হওয়া।
তিনি নারী অধিকার, নারীশিক্ষা নিয়ে কাজ করেছেন বটে, কিন্তু নিজের চিন্তা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া, সমাজে নারীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নকে লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটিও তিনি করেছেন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে। আজও তাঁর রচনাবলি আমাদের জন্য পথপ্রদর্শকের কাজ করছে। এত আধুনিক চিন্তা ও লেখা পাওয়া এখনো দুষ্কর। আবার তিনি শুধু লেখিকা হয়েও বসে থাকেননি। তিনি নারী সংগঠনও করেছেন। ১৯১৬ সালে আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম (মুসলিম মহিলা সমিতি) গঠন করেন। এই সমিতির মাধ্যমে তিনি নারী সম্মেলনের আয়োজন করতেন এবং নারীশিক্ষা ও নারী অধিকার সম্পর্কিত আলোচনা, এমনকি বিতর্কও করতেন। কেন জানি না, এখন নারী আন্দোলনে তাত্ত্বিক বিতর্ক হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা পরস্পরের সঙ্গে যথেষ্ট বিতর্ক করছি না। সবাই যেন সবজান্তা হয়ে বসে আছি। নিজ নিজ কাজের ক্ষেত্রের বাইরে অন্য কিছু সম্পর্কে জানা জরুরি মনে করছি না। আমাদের নিজস্ব আলোচনা বা বক্তব্য তৈরি না করে আমরা নির্ভর করছি বিদেশ থেকে আসা তত্ত্ব ও তথ্যের ওপর। বিদেশ-নির্ভরশীলতা নারী সংগঠনের কাজকে খণ্ড খণ্ড করে দিয়েছে। আমরা কেউ শুধু নারী নির্যাতনবিরোধী কাজ করি, কেউ এইডস, কেউ পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করছি, কেউ ব্যস্ত সিডও নিয়ে। এই সবগুলোর মধ্যে যে যোগসূত্র আছে, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা নেই। নারীর অধিকারের জন্য সোচ্চার আমরা, অথচ ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ দিলে কত নারী যে জীবন-জীবিকা খোয়াবে, সে হিসাব কেউ করছি না। অনেক নারী পরিবেশ আন্দোলনে কিংবা মানবাধিকার আন্দোলনে, এমনকি উন্নয়ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের নারী আন্দোলনে পাওয়া যাচ্ছে না।
বেগম রোকেয়া এতকাল আগেও পরিবেশ, কৃষি ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর ভেবেছেন এবং লিখেছেন। এটা তাঁর দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী কাজ করার প্রমাণ। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করছি, আজ যখন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (৭ থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০০৯) অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে নারী সংগঠনগুলো কোনো বক্তব্য তুলে ধরেনি। এই দোষে আমি নিজেও দোষী, তাই আত্মসমালোচনা হিসেবেই বলছি।
ব্যক্তিগতভাবে বললেও নারী আন্দোলন হিসেবে বলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু নারী সংগঠনের কোনো যৌথ বক্তব্য না থাকার অর্থ হচ্ছে, আমরা খুবই সংকীর্ণ অর্থে নারী অধিকারের বিষয়টি বিবেচনা করছি। সামগ্রিকভাবে নারীমুক্তির প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবনা-চিন্তার চর্চা আমাদের মধ্যে নেই। এই ভুলের মাশুল আমাদের ভবিষ্যতে দিতে হবে। রোকেয়া দিবসে এই ভুল স্বীকার করে নেওয়া আমাদের জন্য জরুরি।
বেগম রোকেয়ার জন্ম আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। তাঁর সময়ে বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামী নারী সক্রিয় ছিলেন, যদিও বর্তমান সময়ের মতো ইন্টারনেট বা ই-মেইল সম্পর্ক তাঁদের মধ্যে ছিল না। জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকনের জন্ম হয়েছিল ৫ জুলাই ১৮৫৭ আর মৃত্যু হয়েছিল ২০ জুন ১৯৩৩। একেবারেই বেগম রোকেয়ার সমসাময়িক। ক্লারা জেিকন এখন বিশ্বের নারী আন্দোলনের প্রতীক, কারণ তিনি ১৯১০ সালে শ্রমিক নারীদের দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন; কোপেনহেগেন শহরেই সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। ১৯১১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সময় ৩০ হাজার নারীর সমাগম ঘটেছিল। কম কথা নয়। ক্লারা জেিকন হয়তো জানতেন না, এই সময় বাংলাদেশের মতো একটি দেশেও নারীর অধিকারের সংগ্রাম চলছে। এই কালে হলে বেগম রোকেয়ার সেই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হওয়া অসম্ভব কিছু হতো না। যা-ই হোক, এটা খুবই প্রাসঙ্গিক যে আজ বেগম রোকেয়া দিবসে বাংলাদেশে আমরা ৮ মার্চ ২০১০ তারিখে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবার্ষিকী উদ্যাপনের প্রস্তুতি নেওয়ার কাজ শুরু করতে চাই।
আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, এই শত বছরে আমাদের অর্জন যা হয়েছে, এর একটি খতিয়ান করা। কিন্তু অর্জন মানে শুধু কী পেলাম তা নয়, কী সংগ্রাম করলাম তাও দেখতে হবে। বিভিন্ন সময়ে আমাদের সংগ্রামের রূপ কী ছিল এবং বর্তমানে নারী আন্দোলনের বিষয় ও এর সঙ্গে সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে সম্পৃক্তির বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা যেতে পারে। যদি অর্জনের কথা বলা হয়, তাহলে অবশ্যই অনেক অর্জন আছে; তবে এর চেয়েও বেশি আছে আমাদের সংগ্রামের শক্তিশালী ইতিহাস। আমরা অনেক কিছু নিয়ে আন্দোলন করেছি, সবকিছুতেই আমরা সফল হইনি ঠিক, কিন্তু আমাদের আন্দোলন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সমাজে প্রশ্ন তুলেছে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পালন করার কাজ করতে গিয়ে আমরা সেই দিকটার প্রতি নজর দিতে চাই। বেগম রোকেয়া দিবস থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস—ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস, বাংলাদেশের নারীদের এই অনন্যসুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আমাদের সৌভাগ্য যে বেগম রোকেয়ার পর এ দেশে আরও অনেক নারী আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে উঠবে—এই আশা ব্যক্ত করছি।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.