বাংলাদেশের একটি হত্যাকাণ্ড: প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেমের দুর্বলতার ক্ষুদ্র বহিঃপ্রকাশ by আফসান চৌধুরী

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় জেলা বরগুনার একটি হত্যাকাণ্ড সারা দেশের মনোযোগ কেড়েছে। রিফাত শরীফ নামের এক তরুণকে বহু মানুষ এবং তার সম্প্রতি বিবাহিত স্ত্রী মিন্নির সামনেই কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নয়ন বন্ডের নেতৃত্বে প্রায় ডজনখানিক তরুণ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। স্থানীয়ভাবে নয়ন বন্ড গ্যাং লিডার হিসেবে পরিচিত।

এই গ্যাংগুলো সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধের মাধ্যমেই টিকে থাকে এবং এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে, নয়ন আর তার গ্রুপ ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা করে আসছে।

কেউ একজন হত্যার দৃশ্য ভিডিও করে এবং একজন খালি হাতের তরুণকে বেশ কয়েকজন কুপিয়ে হত্যা করছে – এই দৃশ্যটি প্রায় সাথে সাথেই জাতীয় সংবাদ হয়ে যায়। নয়ন যে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে, সেটা কোন গোপনীয় বিষয় নয়। কোন মাদক ব্যবসা বা নয়নের মতো ব্যক্তিরা রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা ছাড়া টিকে থাকে না।

পরের ঘটনাগুলো প্রত্যাশিতই ছিল, কারণ এই হত্যাকাণ্ডের ছবিগুলো ভাইরাল হয়ে উঠেছিল। গ্রেফতার ও বিচারের জন্য জনগণের দাবি ওঠে। শিগগিরই বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। পরবর্তী ঘটনাও অনুমেয় ছিল কারণ পুলিশ ঘোষণা দেয় যে, মূল ঘাতক নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হয়েছে।

এই ধারাটা এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে যে কেউ এমনকি এটা নিয়ে মন্তব্য করারও প্রয়োজন মনে করেন না। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের দক্ষতাকে অভিনন্দন জানিয়ে মন্তব্য এসেছে। আরও কয়েকজন ঘাতককে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

কিন্তু নাটক বাড়তে থাকে যখন হত্যাকাণ্ডে রিফাতের স্ত্রী মিন্নির অন্তর্ভুক্তির বিষয় নিয়ে মিডিয়ার আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। ভিডিওতে তাকে দেখা গেছে ঘাতকদের সে ঠেকানোর চেষ্টা করছে।

কিন্তু অন্যান্য ভিডিওতে সাংঘর্ষিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মিন্নি দাবি করেছিলেন যে তিনি নয়ন বন্ডকে চিনেন না, কিন্তু পরে বিয়ের কাবিননামা প্রকাশিত হয়, যেখানে নয়ন বন্ডের স্ত্রী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন মিন্নি। তখন তিনি দাবি করেন যে ওই সার্টিফিকেট ভুয়া। পুলিশ পরে হত্যাকারী গ্যাংয়ের সাথে মিন্নির কথোপকথনের অডিও রেকর্ডও হাতে পায়। যারা গ্রেফতার হয়েছে, তাদের দেয়া স্বীকারোক্তি পুলিশের কাছে রয়েছে, যারা নয়নের সাথে মিন্নির যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

রিফাতের বাবা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছেন যে মিন্নি হত্যার সাথে জড়িত এবং তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। মিন্নি পরে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন যে, তার শ্বশুর শক্তিশালী পক্ষের চাপে পড়ে আসল হত্যাকারীদের আড়াল করার জন্য তাকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করছেন।

পরদিন পুলিশ মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যায়। পরে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ তার রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করে। মিন্নি এখনও নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে যাচ্ছেন কিন্তু রিফাতের ঘাতের সাথে যোগাযোগের বিষয়ে কোন প্রশ্নের তিনি জবাব দেননি।

মিন্নির পক্ষে কোন আইনজীবী মামলা লড়তে রাজি হননি। তার বাবা অভিযোগ করেছেন যে, বেশ কয়েকজন আইনজীবীর দ্বারস্থ হলেও কেউ তাকে সাহায্য করতে রাজি হননি। এই আইনজীবীরা এটা জানাতে অস্বীকার করেছেন যে, কেন তারা সাহায্য করতে চাচ্ছেন না।

এদিকে, মিন্নির রিমান্ড বাতিল চেয়ে করা একটি আবেদন খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্ট বলেছে যে, স্থানীয় আদালতের এই ধরনের রিমান্ড দেয়ার এখতিয়ার রয়েছে। অভিযুক্তকে আইনি সহায়তা দেয়ার বিষয় নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।

তবে, পরদিন, পুলিশ মিডিয়াকে জানায় যে, হত্যা পরিকল্পনায় মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টিতে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।

এনকাউন্টার এবং সোশাল মিডিয়ার উত্থান

অপরাধের ঘটনাগুলো সোশাল মিডিয়ায় প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সেগুলো কারোর নজরেই আসছে না। এটা খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ও অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কোন একটি বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য সেটা সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ওঠাটা যেন গ্রহণযোগ্য শর্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে পুলিশের কাছে আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযোগ দায়েরের কোন দরকার পড়ছে না।

সোশাল মিডিয়া জনগণের ডিজিটাল অভিভাবক হয়ে উঠেছে যেন। কিন্তু এর উপর নির্ভরতা বেশি হওয়ার অর্থ হলো সেখানে আইন প্রয়োগ ও সুশাসনের আনুষ্ঠানিক সিস্টেমের দুর্বলতা রয়েছে।

সরকারের সিস্টেমগুলো কেন পর্যাপ্ত মাত্রায় এইসব ইস্যুর সমাধান করতে পারছে না? এর আংশিক কারণ হলো অপরাধ দমন ও প্রতিরোধ কাঠামোর উপর অনেক বেশি চাপ পড়ে গেছে।

বরগুনা হত্যাকাণ্ড আলাদা একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এর মধ্য দিয়ে আরও বড় ও কুৎসিত একটি বাস্তবতার প্রকাশ ঘটেছে। হত্যাকারীরা নিঃসন্দেহে স্থানীয় ক্ষমতাধরদের সুরক্ষা উপভোগ করে আসছিল। এই ধরনের গ্যাংয়ের জন্ম হওয়ার কারণ হলো মাদক ব্যবসা। মাদক ব্যবসার সুবিধাভোগী হলো তারা যাদের ক্ষমতা রয়েছে। যদিও বড় একটা সমালোচনা হচ্ছে স্থানীয় এমপির ছেলেকে ঘিরে, কিন্তু মাদক মাফিয়াদের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।

সরকার নিয়মিতভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের হত্যা করে আসছে কিন্তু মাদক পরিস্থিতির উপর এর প্রভাব এখনও পড়তে দেখা যায়নি। ঢাকার বাইরে আইন প্রয়োগকারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাধর – উভয়ের বিরুদ্ধেই মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এই যোগসাজশের বিষয়টি স্পষ্ট কিন্তু এটা কতটা গভীর, সেটা এখনও অজানা রয়ে গেছে।

এমনটাও মনে হচ্ছে যে, কিছু ব্যক্তি অন্যদের চেয়ে বেশি নিরাপদে আছেন। তাই কিছু অপরাধ ঘটতে দেয়া হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক আইন প্রয়োগকারী সিস্টেম এবং আইনের শাসন যেহেতু ব্যর্থ হচ্ছে, সে কারণে ভুক্তভোগীদের বৃত্তটি ক্রমেই বড় হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.