মশার ওষুধে টালমাটাল অবস্থা by ফারুক আলম

সর্বত্রই এখন ডেঙ্গু আক্রান্তে ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন মশার ওষুধ আমদানিতে টালমাটাল অবস্থা। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, ওষুধ আমদানিতে সিন্ডিকেট ভাঙা হয়েছে।

অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নতুন ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করতেই কয়েকদিন সময় লাগিয়েছে। এখনো চূড়ান্ত কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি। মশার ওষুধের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনিদের্শনা দিতে পারছে না।

গতকাল বুধবার এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) দ্বিতীয় ধাপের মশার ওষুধ মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। নতুন ওষুধটির উৎপাদনকারী ট্র্যাগরোজ নামে ভারতীয় একটি কোম্পানি।

নগরভবনের মূল ফটকের সামনে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ডিএসসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে মশার ওষুধের পরীক্ষা সন্তুষ্টজনক। এখন ল্যাব টেস্ট এবং সর্বশেষ প্ল্যান্ট প্রটেকশন টেস্ট করা হবে।

ডিএসসিসির ৭ তলার ৬১৯ কক্ষে সিলগালা করে রাখা তিন ধরনের ওষুধের তিনটি করে নয়টি খাঁচা ও দুটিতে ওষুধ প্রয়োগ ছাড়াই মোট ১১টি পরীক্ষার খাঁচা বের করা হয়। এরপর নুরুজ্জামান বলেন, ভারত থেকে সংগৃহীত নমুনা ওষুধের ফিল্ড টেস্ট রিপোর্ট পর্যালোচনায় ওষুধ শতভাগ কার্যকর। সংগৃহীত নমুনার ম্যালাথিউন ৫% ও ডেলটাম্যাথরিন ১.২৫% নামের দুটি ওষুধ ১০০ ভাগ কাজ করেছে। এই নমুনা ওষুধকে মাঠপর্যায়ে শতভাগ উত্তীর্ণ।

এ সময় কৃষি অধিদপ্তরের প্ল্যান্ট প্রটেকশন উইংয়ের যুগ্ম পরিচালক ড. আমিনুর ইসলাম বলেন, এটি মাঠপর্যায়ে ওষুধ পরীক্ষা হয়েছে। এতে ২৪ ঘণ্টায় ৮০ শতাংশ মশা মরলেই ওষুধ কার্যকর ধরা হয়। এখন তিনটি ওষুধই গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে।

সেখানে প্রতিটি ওষুধের উপাদান উত্তীর্ণ হলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্ল্যান্ট প্রটেকশন উইংয়ে মশার ওষুধের গবেষণা করতে সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, ফগার মেশিনের ওষুধের গুণগতমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু লার্ভাসাইটের ওষুধ নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেনি।

আইইডিসিআর’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মিনতি সাহা বলেন, মশার ওষুধ টেস্ট করতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগবে। এখন সিটি কর্পোরেশন মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করছে। এসব ওষুধ তিন ধাপে পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর চূড়ান্ত হবে।

ডিএসসিসির মশার ওষুধসহ আরও দুটি নতুন ওষুধ পরীক্ষা করে। সেখানে সিটি কর্পোরেশন বর্তমানে যে ওষুধ ব্যবহার করছে সেটিতে ৯৯ শতাংশের বেশি মশা মারা গেছে। আর নতুন দুটি ওষুধের একটি ১০০ ভাগ অন্যটিতে ৯৯.৩৩% মশা মারা গেছে।

এ ব্যাপারে নুরুজ্জামান বলেন, যে ওষুধে ৮০ শতাংশ মশা মরে সেটি কার্যকর ধরা হয়ে থাকে। মাঠপর্যায়ে ওষুধ উত্তীর্ণ হয়েছে। ওষুধের চূড়ান্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আশা করি দুই-তিন দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে ওষুধের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।

জানা যায়, দুই দিনের ব্যবধানে দুইবার মশার ওষুধ পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রথম ধাপের ওষুধ মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় অকার্যকর হওয়ায় দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষা চালায়। এতে দ্বিতীয় ধাপের ওষুধ মাঠপর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। প্রথম ধাপের মশার ওষুধ পরীক্ষায় ৩০ মিনেটের ব্যবধানে সর্বোচ্চ ২৬ শতাংশ মশা ভূপাতিত হয়।

দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় ২০ মিনেটে ৮০ শতাংশ মশা ভূপাতিত হয়েছে। প্রথম ধাপের পরীক্ষার ওষুধ অকার্যকর। দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষার মশার মাঠপর্যায়ে কার্যকর ও সন্তোষজনক। তবে ল্যাবে পরীক্ষার পরেই নতুন মশার ওষুধ সিটি কর্পোরেশন আমদানি করবে।

সিন্ডিকেটে জিম্মি হয়ে আছে মশার ওষুধ আমদানি। হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে মশার ওষুধ। লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট এবং নোকন- এ দুই কোম্পানি ওষুধ সরবরাহ করছে সিটি কর্পোরেশনগুলোয়।

এর মধ্যে দীর্ঘদিন মশক নিধনে ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অভিযোগে লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। ফলে প্রয়োজনেই আর একটি কোম্পানির কাছ থেকে ওষুধ নিতে হচ্ছে।

এ ব্যাপারে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে দুটি কোম্পানি ওষুধ আনবে, বাকিরা কেন পারবে না? একটি বা দুটি কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে আজ পুরো জাতির কাছে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ। আমদানিকারক থাকলেও তারা ওষুধ আমদানি করতে পারছে না। দুটি কোম্পানি পুরো সিস্টেমকে ম্যানেজ করে রেখেছে। এটা চলতে পারে না।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশে ওষুধ আমদানির বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। পেস্টিসাইড কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (পিটাক) সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক কৃষিকাজে ব্যবহার্য ও জনস্বাস্থ্যে ব্যবহার্য বালাইনাশক দ্রব্যাদির নতুন রেজিস্ট্রেশনের জন্য কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

এখানে প্রোডাক্টের তথ্য-উপাত্ত, কারিগরি মূল্যায়ন, মিশ্রণের পরিমাণ এবং মূল্যায়ন, ভ্যাট সার্টিফিকেট, কোম্পানি মালিকের জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংকের সচ্ছলতা সনদ, এনওসি, প্রোডাক্ট নমুনা মূল্যায়ন এবং বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিপিএ) নতুন নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।

কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তিকে বিধিমালা হিসেবে প্রচার করে সিন্ডিকেটে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে দেশের কীটনাশক আমদানি খাতকে। তিন-চারটি কোম্পানির হাতে রয়েছে এই আমদানির চাবিকাঠি। নতুন কোনো কোম্পানিকে এই ধাপগুলো পার করে ওষুধ আমদানির সুযোগ দেয় না এই সিন্ডিকেট।

দীর্ঘদিন ধরে এসব মশার ওষুধ অকার্যকর প্রমাণিত হলেও সিন্ডিকেটের কারণে নতুন ওষুধ কিনতে পারছে না সিটি কর্পোরেশন। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর গবেষণায় এসব ওষুধ অকার্যকর প্রমাণিত হলেও তাদের কাছ থেকেই ওষুধ কিনতে হচ্ছে।

দুই সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে যে ওষুধগুলো ছিটানো হচ্ছে- সেগুলো আইসিডিডিআর,বি ঘোষিত অকার্যকর ওষুধ। নতুন ওষুধ কেনার আগ পর্যন্ত এগুলো ব্যবহার করা হবে।

এ মুহূর্তে কোনো বিকল্প না থাকায় সংশ্লিষ্টরা ওষুধগুলোকে কার্যকর প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো পরীক্ষায় এ ওষুধ কার্যকর বা মানসম্পন্ন প্রমাণিত হয়নি। তবে গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মাঠপর্যায়ের পরীক্ষায় সিটি কর্পোরেশনের ব্যবহূত মশার ওষুধকে কার্যকর বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.