রংপুরেই এরশাদের সমাধি by পিয়াস সরকার

সকাল থেকেই রংপুরের আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। গুমোট আবহাওয়ার মতো রংপুরের মানুষের মনও ছিল শোকাচ্ছন্ন। শোকের সঙ্গে ক্ষোভ আর দাবি আদায়ের উচ্চারণ। ভিন্ন এ পরিবেশ ছিল দুপুর পর্যন্ত। দুপুরের পর প্রিয় নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লাশ যখন কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে আসে তখন লাখো মানুষের জমায়েত সেখানে। এরশাদকে রংপুরে সমাহিত করার দাবি মুখে মুখে। কারও কারও হাতে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার।
জানাজার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন নেতারা। কিন্তু এরশাদকে কোথায় দাফন করা হবে এর কোন ঘোষণা আসছিল না। এতে বাড়ে ক্ষোভ। হতাশা। নেতাকর্মীরা থেমে থেমে স্লোগান দিতে থাকেন। ‘এরশাদের সমাধি-রংপুরে, রংপুরে’। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দাফনের ঘোষণা না দিয়েই জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপর এরশাদের কফিনবাহী গাড়ি ঘিরে ধরেন হাজারো নেতাকর্মী। এসময় কেন্দ্রীয় নেতারা ঘোষণা দেন এরশাদকে রংপুরেই দাফন করা হবে।

তখন নেতাকর্মীদের বিজয়ধ্বনি। রংপুর নগর পিতা জাপা নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা লাশবাহী গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসেন। নির্দেশনা দেন গাড়ি চালিয়ে এরশাদের পল্লী নিবাসের দিকে নিয়ে যেতে। গাড়ি চলতে থাকে। গাড়িবহর ঘিরে হাজার হাজার নেতাকর্মী। তারা প্রায় কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয় গাড়ি বহরকে ঘিরে রেখেই। বিকাল পৌনে ছয়টার পর এরশাদের হাতে গড়া পল্লি নিবাসেই চির নিদ্রায় শায়িত করা হয় তাকে। আর এর মধ্য দিয়ে তার দাফন নিয়ে কয়েক দিনের উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটে। শনিবার এরশাদের মৃত্যুর পর ঘোষণা দেয়া হয়েছিল রাজধানীর বনানীর সামরিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। গতকাল সকালে ঢাকা থেকে রংপুরে এরশাদের লাশ নিয়ে যাওয়ার আগে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও একই কথা জানিয়ে এর পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়েছিলেন। বনানী কবরস্থানে কবরও খোড়া হয়েছিল। দাফনের সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল।

ঘড়ির কাটা তখন সকাল ৯ টায়। এরই মধ্যে রংপুর কালেক্টরেট ঈদ গাহ মাঠে বাড়তে থাকে  নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ভিড়। উদ্দেশ্য প্রিয় নেতার জানাজায় অংশগ্রহণ ও শেষ বিদায়। রংপুর সেন্ট্রাল রোডের জাপা কার্যালয় নেতাকর্মীতে পূর্ণ। তখন থেকেই আওয়াজ উঠতে থাকে এরশাদের লাশ রংপুরে দাফনের। এরশাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে শহরের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুপুর ২ টা পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়। আর আশপাশের জেলা উপজেলা থেকে বাসে ট্রাকে করে আসতে থাকেন  নেতাকর্মীরা। জানাজা নামাজের মাঠেই উপস্থিত ছিলেন রংপুরের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তাফা। এরশাদের মৃত্যুর পর তিনি রংপুর জাপার পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন রংপুরে এরশাদের দাফন না হলে প্রয়োজনে কঠিন কর্মসূচি দেয়া হবে।

কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠ এরশাদের পল্লী নিবাস থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে। এই মাঠেই ঈদের নামাজ আদায় করতেন তিনি। সেই মাঠেই জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করা হয়। মাঠ আগে থেকেই ছিল প্রস্তুত। সামিয়ানা টাঙানো ও মঞ্চও বানানো হয় সোমবার। জানাজা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। সকাল সাড়ে ১০টায় এরশাদকে বহন করা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার তেজগাঁও বিমনবন্দর থেকে রংপুরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। মরদেহের সঙ্গে যান জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের, এরশাদের বড় ছেলে রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদ, জাপা মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, সাবেক মহাসচিব এ বিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, মেজর (অব.) খালেদ আখতার, আজম খান, এটিইউ তাজ রহমান ও শফিকুল ইসলাম সেন্টু। মরদেহবাহী হেলিকপ্টারটি দুপুর ১২ টায় রংপুর ক্যান্টনমেন্টে অবতরণের পরে সেখান থেকে এরশাদের লাশ সরাসরি কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রথমে পুলিশের পক্ষ থেকে এরশাদকে দেয়া হয় সম্মান সূচক গার্ড অব অনার। কয়েক মিনিট মঞ্চে রাখার পর ফের জনতার চাপে নেয়া হয় গাড়িতে। এরপরে সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রংপুর মহানগর সভাপতি সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান জাতীয় পার্টি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা। এসময় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রীতিমতো বেগ পেতে হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি নেতাকর্মীরা স্লোগান দেন ‘লাশ নিয়ে রাজনীতি চলবে না চলবে না।’

বাদ যোহর এ মাঠেই জানাজা নামাজের কথা থাকলেও নেতাকর্মীদের রংপুরে দাফনের দাবির কারণে বিলম্বিত হয়। জোহরের নামাজের পর জানাজার পূর্ব মুহুর্তে ঈদগাহ মাঠে আসেন জি এম কাদের, মসিউর রহমান রাঙ্গাসহ নেতারা। জানাজার নামাজের পূর্বে বক্তব্য রাখেন রাঙ্গা। তিনি বলেন, আমরা অভিভাবক শুন্য হয়েছি। এরশাদের মৃত্যু আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের মিইয়ে গেলে চলবে না। পার্টির নতুন অভিভাবক জি এম কাদের। আপনারা তার কথা মানবেন? এরপর সবার হাত উচিয়ে সম্মতি নেন। 

জি এম কাদের তার বক্তব্যের শুরুতে এরশাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এরশাদের শাসন আমলে আমরা উপজেলা পেয়েছি, জেলা পেয়েছি ৬৪টি। তিনি আমাদের বাংলাদেশের সকল উন্নয়নের নায়ক। তিনি যেসব আইন করেছেন সেসব আইন আমাদের  দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি সাবেক সফল রাষ্ট্রপ্রধান, তিনি সাবেক সেনাপ্রধান, বিরোধী দলীয় নেতা। তার লাশ দাফন করা উচিত সম্মানের সঙ্গে। তাই আমরা চাই তার লাশ ঢাকায় দাফন করতে। এই কথার পরেই চারদিকে শোরগোল উঠে না, না। উত্তেজিত জনতার স্লোগানে আর একটি কথাও বলতে পারেননি জি এম কাদের। নির্ধারিত সময়ের ৪০ মিনিট পর অনুষ্ঠিত হয় জানাজা। নামাজ শেষেই ফের উত্তপ্ত ময়দান। লাশের গাড়ি ঘিরে রাখেন নেতাকর্মীরা। তারা ফের স্লোগান দিতে থাকেন লাশবাহী গাড়ি ঘিরে। আবারও ৪০ মিনিটি দেরি হয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পরিস্থতি। এরপর সিটি মেয়র এরশাদকে রংপুরে দাফনের ঘোষণা দিলে গাড়ি ছাড়েন নেতাকর্মীরা। দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে ঈদগাহ মাঠ ছাড়ে লাশবাহী গাড়ি। ঈদ গাহ মাঠ থেকে বেরিয়ে বা পাশের সড়ক দিয়ে পল্লী নিবাস আর ডানের রোডে সেনানিবাস। ডানের রোডে নেতাকর্মীদের ভিড় ও হাতে হাত রেখে নেয়া অবস্থান ছিলো চোখে পড়ার মতো। এই ঈদগাহ মাঠ থেকে গাড়ি তারা হেঁটে নিয়ে যান পল্লী নিবাসে।

প্রায় ৬ কিলোমিটার রাস্তা লাখো মানুষ গাড়ি ঘিরে নিয়ে যান এরশাদের বাড়িতে। এতে সময় লাগে ২ ঘণ্টারও বেশি। আর লাশ বাহী গাড়ির সামনে বসা ছিলেন মেয়র মোস্তফা। বিকাল ৪ টা ৫০ মিনিটে মরদেহ পৌঁছায় পল্লী নিবাসে। সেখানে আগে থেকেই সেনাবাহিনীর একটি দল প্রস্তুত ছিল। গাড়ি থেকে এরশাদের মরদেহ সেনা সদস্যরা ফুল সজ্জিত এক কফিনে নামিয়ে নেন। এরপর ফের গার্ড অব অনার দেয়া হয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিকাল ৫টা ৪৬ মিনিটে দাফন করা হয় এরশাদকে। দাফনের পূর্বে সেনাবহিনীর পক্ষ থেকে এরশাদের কর্মজীবন তুলে ধরা হয়।

বননীতে দাফনের সব প্রস্তুতি ছিল: এরশাদকে দাফনের জন্য ঢাকার বনানীর সামরিক কবরস্থানে সবধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কবর খুঁড়ে রাখা ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কবরস্থানের প্রবেশ রাস্তা বন্ধ করে দেন। বনানীতে দাফন করা হবে জেনে পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আশেপাশে অবস্থান নেন। কিন্তু বিকাল ৩ টার দিকে রংপুরে দাফনের খবর এলে তারা চলে যান।
নেতাকর্মীরা এরশাদের মরদেহ নিয়ে যাচ্ছেন পল্লী নিবাসে -ছবি: জীবন আহমেদ

No comments

Powered by Blogger.