মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে সিলেটের দুদুকে ‘গণপিটুনিতে’ হত্যা by ওয়েছ খছরু

সিলেটের বনকলাপাড়ার দুদু খান নিজেও ছিল চিহ্নিত অপরাধী। পহেলা বৈশাখের পরদিন রাতে সিলেটের আলোচিত গ্যাং রেপের ঘটনা ঘটিয়েছিল সে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারের পর কারাবরণ করে বেরিয়ে আসার পর এলাকার আরেক প্রভাবশালী মহল গণপিটুনির নাটক সাজিয়ে সেই দুদু খানকে বেধড়ক পিটুনি দিয়ে হত্যা করেছে। আর হত্যার পর তার হাতে রামদা দিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখে। গত বুধবার মধ্যরাতে সিলেট নগরীর বনকলাপাড়ার ইসলামাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর উত্তেজনা বিরাজ করছে এলাকায়। দুদু খানকে স্বেচ্ছাসেবকলীগ কর্মী দাবি করেছে তার পরিবার।
ঘটনার সম্পর্কে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততাকে দায়ী করেছে পরিবারের সদস্যরা। তবে গণপিটুনিতে হত্যা করা দুদু খানের মৃত্যু নিয়ে নানা রহস্য দেখা দিয়েছে এলাকায়। গত পহেলা বৈশাখের পরের দিন সিলেট নগরীর বনকলাপাড়ার ইসলামাবাদ এলাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল জকিগঞ্জের আরেক বোন। রাতে দুদু খানের নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক মিলে ওই মহিলাকে বাড়ির বাইরের নির্জন স্থানে এনে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ওইদিনই পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুদুসহ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। এ ঘটনায় প্রায় দেড় মাস কারাবরণের পর সপ্তাহখানেক আগে জামিনে বেরিয়ে আসে দুদু খান। এসে সে নিজ এলাকাতেই ছিল।
পুলিশ জানিয়েছে, দুদুর বিরুদ্ধে আরো দুটি চাঁদাবাজি মামলা ছিল। কারান্তরীণ হওয়ার পর সে ওই দুই মামলায় জামিন পেয়ে যায়। তবে এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম ছিল। নানা অপরাধে জড়িত ছিল সে। দুদু খান আগে সিলেটের ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। প্রায় দুই বছর ধরে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকলীগের জুনিয়র কর্মীদের সঙ্গে ওঠাবসা করতো। তবে সে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কোনো কমিটিরই পদপদবিতে ছিল না। কেউ কেউ দুদু খানকে স্থানীয় ৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আপ্তাব আলী খানের অনুসারী বলে দাবি করেন। তবে স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে তাকে অনুসারী হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছে। দুদু খান বনকলাপাড়ার ইসলামাবাদ এলাকার ১১২নং বাসার বাসিন্দা। তার মূল বাড়ি হচ্ছে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলশোকা গ্রামে। তার পিতা মৃত তমিল খান।
দীর্ঘদিন তারা বনকলাপাড়া এলাকায় বসবাস করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুদু খান গত বুধবার রাত ১১টার দিকে তার ভাই হাসেম খানের দোকানে বসা ছিল। এ সময় স্থানীয় রিপন, শাহ আলম, কালা জামাল, বেলাল আহমদ ও মনু মিয়াসহ ১০-১২ জন লোক সাদিয়া টেলিকমে যায়। ওই দোকানে বসা দুদু মিয়ার সঙ্গে তাদের কথাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ওই যুবকরা দোকানে হামলা চালায়। তারা দোকান ভাঙচুর করে। এ সময় দোকানে দুদু খানের সঙ্গে তার ভাই জুয়েলও ছিল। হামলার ঘটনার সময় জুয়েল দৌড়ে পালিয়ে যায়। দুদু খান তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ওই যুবকরা দুদু খানকে দোকান থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখে। ওই সময় তারা দুদু খানকে নিয়ে একটি বাড়িতে ঢোকেন। সেখানেও তারা দুদু খানকে এলোপাতাড়ি কোপায় এবং মারধর করে। এদিকে, মধ্যরাতের দিকে বনকলাপাড়া ইসলামাবাদ জামে মসজিদের মাইকে এলাকায় ডাকাত পড়েছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। এ ঘোষণার পর ওই যুবকরা মৃতপ্রায় দুদু খানকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে আসে।
এবং ডাকাত ডাকাত বলে তারা দুদু খানকে মারতে থাকে। এ সময় মাইকিং শুনে এগিয়ে আসা জনতাও দুদু খানকে কিল ঘুষি এবং লাথি মারে। এদিকে ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান স্থানীয় কাউন্সিলর আপ্তাব আলী খান। তিনি পুলিশে খবর দিলে দুদু খানকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে কর্তব্যরত ডাক্তার দুদু মিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুদু খানকে ঘটনাস্থলেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আর মারা যাওয়ার পর তার হাতে একটি রামদা রাখা হয়। পুলিশ লাশ উদ্ধারের সময় দুদু খানের হাতে রামদা পেয়েছে। স্থানীয় কাউন্সিলর আপ্তাব আলী খান মানবজমিনকে জানিয়েছেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে স্থানীয় লোকজনকে থামাই। এ সময় পুলিশ এসে দুদুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তিনি বলেন, দুদু অপরাধী ছিল।
কিন্তু তাকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা কারো কাম্য নয়। বিচার হাতে তুলে নেয়া উচিত নয়। এ ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। দুদুর ভাই কলাপাড়া পয়েন্টে নিউ সাদিয়া টেলিকমের মালিক হাসেম খান বলেন, ??‘পরিকল্পিতভাবে আমার ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করেছে জামায়াত কর্মী রিপন, ছাত্রদল ক্যাডার ও একাধিক মামলার আসামি শাহ আলম, কালা জামাল, বেলাল আহমদ ও আওয়ামী লীগ কর্মী মনু। তিনি বলেন, দুদুকে হত্যার আগে আমরা চার ভাইয়ের ও আমার এক খালার পীরমহল্লার বাসায় ও আমার নিউ সাদিয়া টেলিকম নামের দোকানে হামলা করে ভাঙচুর করে। পরে দুদু খানকে রাস্তায় পেয়ে পিটিয়ে হত্যা করার পর মাইকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ডাকাত পড়েছে বলে জনতাকে জড়ো করে। এদিকে, সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার ওসি সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে দুদুর লাশ পরিবারের কাছে দেয়া হয়েছে। লাশ কবর দিয়ে আসার পর তারা মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি জানান, দুদুর সঙ্গে এলাকার বিরোধ পুরনো। পূর্বের ঘটনায় এলাকার কয়েকজন তাকে পিটিয়ে খুন করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মামলা দিলে তদন্ত করা হবে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.