বাসচালকের সহকারীর স্বীকারোক্তি by আশরাফুল ইসলাম

চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর নার্স শাহিনুর আক্তার তানিয়া হত্যার ঘটনায় বাসচালক নূরুজ্জামান নূরুর পর এবার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে হেলপার লালন মিয়া (৩২)। গতকাল বিকালে কিশোরগঞ্জের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আল-মামুন বাসের হেলপার লালন মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে হেলপার লালনকে কিশোরগঞ্জ জেলা   কারাগারে পাঠানো হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সারোয়ার জাহান ১৬৪ ধারায় হেলপার লালন মিয়ার স্বীকারোক্তি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এর আগে গত ১১ই মে মামলার প্রধান আসামি স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। বাসচালক নূরুজ্জামান নূরুর পর হেলপার লালন মিয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ায়, চাঞ্চল্যকর এই মামলার তদন্তে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাসের হেলপার লালন মিয়া আদালতে দেয়া তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরুর মতো একই ধরনের তথ্য দিয়েছে। নূরুর মতোই হেলপার লালন মিয়া পাশবিক এই গণধর্ষণের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে।
জবানবন্দিতে লালন জানিয়েছে, বাসচালক নূরুর খালাতো ভাই বোরহান স্বর্ণলতা পরিবহনেরই হেলপার। কিন্তু ঘটনার দিন ৬ই মে তার ডিউটি ছিল না। স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৪২৭৪) ঢাকা থেকে পিরিজপুরে আসার পথে, বোরহান কাপাসিয়া উপজেলার বীর উজুলী থেকে বাসটিতে ওঠে। বাসটি কটিয়াদী পার হওয়ার পর বাসে বাসচালক নূরু, হেলপার লালন ও নূরুর খালাতো ভাই বোরহান এই তিনজন ছিল। কটিয়াদী থেকে পিরিজপুরের পথে একজন মধ্যবয়সী বাস থেকে নেমে পড়লে তানিয়া একা হয়ে পড়েন। এসময় বাসের ভেতরে তানিয়াকে একা পেয়ে ধর্ষণ করার ফন্দি আঁটতে থাকে চালক নূরু, হেলপার লালন মিয়া ও তাদের সহযোগী বোরহান। বাসটি বাজিতপুর উপজেলার বিলপাড় জামতলী নির্জন স্থানে একটি কলাবাগানের কাছে এলে বাসের সব জানালা লাগিয়ে দেয় তারা। তখন পেছনের একটি আসনে বসা ছিলেন তানিয়া। এ সময় চালক নূরু তার আসন ছেড়ে হেলপার লালনকে বাস চালাতে দেয়। লালন বাস চালানোর সময়ে বোরহান ও নূরু মেয়েটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। পরে নূরু ড্রাইভিং সিটে বসলে লালনও মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, মামলার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে এসে গেছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও তারা পেয়ে গেছেন। বোরহান, নূরুজ্জামান ও লালন মিয়া পালা করে তানিয়াকে ধর্ষণ করে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে তানিয়াকে বাস থেকে ফেলে দেয়। বাস থেকে ফেলে দেয়ার সময় তানিয়ার শরীর পেছনের দিকে ছিল বলে তানিয়ার মাথা সড়কে আঘাত করে। তাই তানিয়ার মাথার পেছনের অংশ মারাত্মকভাবে ফেটে গিয়ে দু’ভাগ হয়ে যায়। মাথার পেছনের দিকের দু’টি হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও দীর্ঘ সময় চিকিৎসা না পাওয়ায় তানিয়ার মৃত্যু হয়।
আদালত ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৬৪ ধারায় দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হেলপার লালন মিয়া ওইদিন যা যা হয়েছে সমুদয় ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে। তার দেয়া তথ্যের সঙ্গে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরুর জবানবন্দির মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। দু’জনের জবানবন্দিতেই প্রথম ধর্ষণকারী হিসেবে বোরহানের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু ঘটনার ৯ দিন পার হলেও এ ঘটনার অন্যতম আসামি ধর্ষক বোরহানকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সারোয়ার জাহান বলেন, বোরহানকে গ্রেপ্তারে চিরুনি অভিযান চলছে। বোরহানের বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। সেখানে পুলিশ যোগাযোগ করে তার সম্পর্কে খোঁজখবর করেছে। কিন্তু সে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে রয়েছে। তবে বোরহান পুলিশের জালে ধরা পড়বেই বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে সোমবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জমা পড়া ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ধর্ষণ শেষে তানিয়াকে হত্যা করা হয়। তানিয়ার শরীরের অন্তত ১০টি স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মাথার  পেছনের আঘাত ছিল সবচেয়ে গুরুতর। ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের ফলে তার মাথার পেছনের খুলি ফেটে দুই ভাগ হয়ে যায়। এ ছাড়া মাথার পেছনের দিকের দু’টি হাড় ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। ধর্ষণের পর মাথার এই আঘাতের কারণেই মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে তানিয়ার মৃত্যু হয়।
গত ৬ই মে রাতে তানিয়া হত্যাকাণ্ডের পরদিন ৭ই মে রাতে নিহত শাহিনুর আক্তার তানিয়ার পিতা মো. গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু, হেলপার লালন মিয়া, হাসপাতালে তানিয়ার মরদেহ আনয়নকারী আল আমিন এবং পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন এই চারজনের নামোল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা বেশ কয়েকজনকে আসামি করে বাজিতপুর থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেছিলেন। মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামির মধ্যে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু ও হেলপার মো. লালন মিয়া এই দু’জন ছাড়াও কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো. রফিকুল ইসলাম রফিক, লাইনম্যান মো. খোকন মিয়া ও পিরিজপুর কাউন্টার মাস্টার মো. বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুলকে ঘটনার রাতেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের মধ্যে বাসের চালক মো. নূরুজ্জামান নূরু গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক নয়নবাজার ইউনিয়নের সালুয়াটেকি গ্রামের মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে, হেলপার মো. লালন মিয়া একই ইউনিয়নের বীর উজুলি গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে, মো. রফিকুল ইসলাম রফিক একই উপজেলার বাড়িসাবর ইউনিয়নের লোহাদি গ্রামের নজর আলীর ছেলে, মো. খোকন মিয়া কটিয়াদী উপজেলার ভোগপাড়া এলাকার দুলাল মিয়ার ছেলে এবং মো. বকুল মিয়া ওরফে ল্যাংড়া বকুল বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর ইউনিয়নের নিলখী মৃত আব্দুস শহিদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে গত ৮ই মে আদালত গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচ আসামির প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৮ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুরের পর ওইদিন তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের মধ্যে বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু ও বাসের হেলপার লালন মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
নিহত শাহিনুর আক্তার তানিয়া কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরী ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে। তিনি ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কল্যাণপুর শাখায় সিনিয়র স্টাফ নার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কর্মস্থল ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার জন্য গত ৬ই মে বিকালে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণলতা পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো ব-১৫-৪২৭৪) ওঠেন শাহিনুর আক্তার তানিয়া। স্বর্ণলতা পরিবহনের বাস মহাখালী থেকে কটিয়াদী হয়ে বাজিতপুর উপজেলার পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলাচল করে। বাসে ওঠে তানিয়া তার বাবাকে জানান, তিনি পিরিজপুর বাসস্ট্যান্ডে নামবেন। কিন্তু বাড়িতে ফিরতে দেরি হওয়ায় রাত সাড়ে ৮টায় তানিয়ার মোবাইলে ফোন করে নম্বরটি বন্ধ পান বাবা গিয়াস উদ্দিন। রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফোন করে এক ব্যক্তি গিয়াস উদ্দিনকে জানায়, তার মেয়ে বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে এবং বর্তমানে সে কটিয়াদী হাসপাতালে রয়েছে। এ খবর পেয়ে স্বজনেরা হাসপাতালে গিয়ে তানিয়াকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পড়ে থাকতে দেখেন।

No comments

Powered by Blogger.