যুক্তরাষ্ট্র-ইরান মুখোমুখি বাড়ছে উত্তেজনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান মুখোমুখি! বাড়ছে উত্তেজনা। বাজছে যুদ্ধের দামামা। চারদিক দিয়ে ইরানকে ঘিরে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ। ইরানও মাথা নিচু করে কথা বলছে না। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো সময় আরেকটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার হিম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ আতঙ্ককে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গতকালের এক নির্দেশনায়। ওই নির্দেশনায় ইরাকের রাজধানী বাগদাদে অবস্থিত দূতাবাস ও ইরবিলে কন্স্যুলেট ত্যাগ করতে বলা হয়েছে অপ্রয়োজনীয় (নন-ইমার্জেন্সি) স্টাফদের। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের প্রতিবেশী ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা যখন টগবগ করে ফুটছে, ঠিক তখনই এ নির্দেশ দেয়া হলো। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি জানিয়ে দিয়েছেন, ওয়াশিংটন জানে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ নিজ স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। তারা শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হবে। ইরান বিজয়ীর বেশে শির উন্নত করে বেরিয়ে আসবে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপিসহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
কয়েকদিনে তেহরানের ওপর  প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে ওয়াশিংটন। তারা অভিযোগ করছে, ওই অঞ্চল ও পারস্য উপসাগরে আমেরিকান সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে অবিলম্বে বা তাৎক্ষণিক হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে তেহরান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইকেল পম্পেও দাবি করেছেন, তার দেশ ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ চাইছে না। তা সত্ত্বেও উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। কারণ, কয়েক দিনে ইরানের চারপাশে পারস্য উপসাগরে মোতায়েন করা হয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যবস্থা। মোতায়েন করা হয়েছে যুদ্ধবিমান বহনকারী জাহাজ, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইরাকের বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস ও ইরবিলে কন্স্যুলেটে সাময়িক সময়ের জন্য স্বাভাবিক ভিসা প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে। পাশাপাশি ওই দুটি স্থান থেকে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে কি পরিমাণ মার্কিন কর্মকর্তা এই নির্দেশের ফলে সরে যাবেন তা স্পষ্ট নয়।
ইরানের দিক থেকে আসতে পারে এমন ‘আনস্পেসিফায়েড’ হুমকি মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মোতায়েন করেছে যুদ্ধবিমান বহনে সক্ষম জাহাজ, বি-৫২ বোম্বারস, এফ-১৫ যুদ্ধবিমান ও প্যাট্রিয়ট মিসাইল ব্যাটারিজ। ইরানের চারদিকে মোতায়েন করা যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান এরই মধ্যে ‘ডিটারেন্স’ মিশন শুরু করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্যাটিক শ্যানাহান বলেছেন, এসবই মোতায়েনের মাধ্যমে ইরানের কাছে একটি বার্তা দিতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তাহলো, মার্কিনি অথবা আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো রকম হামলা হলে যথোপযুক্ত জবাব দেয়া হবে।
পারস্য উপসাগরে মার্কিন এমন রণপ্রস্তুতির মধ্যেই ‘স্যাবোটাজ’ রহস্য সৃষ্টি হয়। তাতে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন প্রথম ঘটনায় সৌদি আরবের নৌযানে হামলা হয়েছে। সর্বশেষ আরামকো তেলক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার করে হামলা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এসব রণপ্রস্তুতিকে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলুশনারি গার্ড করপোরেশন।
উত্তেজনা আছে কিন্তু যুদ্ধ হবে না: খামেনি
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলবার এক সমাবেশে ভাষণ দেয়ার সময় তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা কখনো সামরিক পর্যায়ে যাবে না এবং কার্যত কোনো যুদ্ধের আশংকাও নেই। মঙ্গলবার সন্ধ্যার ওই সমাবেশে যোগ দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানী, পার্লামেন্ট স্পিকার, বিচার বিভাগের প্রধান, তিন বাহিনীর প্রধানগণ, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রধান, সংসদ সদস্যগণসহ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ। এ সময় খামেনি বলেন, ওয়াশিংটন জানে ইরানের সঙ্গে সংঘর্ষ নিজ স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলায় ইরানি জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সংঘাতে শেষ পর্যন্ত মার্কিনিরা পিছু হটতে বাধ্য হবে। তাই আমরা কিংবা তারা, যারাই মনে করে যুদ্ধ তাদের অনুকূলে যাবে না তাদের কেউই যুদ্ধ চায় না। দু’দেশের চলমান উত্তেজনা হচ্ছে ‘আকাঙ্ক্ষার সংঘাত’। এই সংঘাতে শেষ পর্যন্ত ইরান বিজয়ীর বেশে উন্নত শির নিয়ে বেরিয়ে আসবে। চলমান উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রামপ ইরানকে বেশ কয়েকবার আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ বিষয়ে খামেনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আবারো আলোচনা হচ্ছে বিষপান করার সমান। দেশটি আলোচনা করতে চায় দরকষাকষির স্বার্থে। তাদের উদ্দেশ্য আমাদের শক্তিমত্তায় আঘাত দেয়া। তারা আমাদের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। তাদের দাবি মেনে নিয়ে কেউ আলোচনায় বসলে সে বোকার স্বর্গে বাস করছে।
অভিযোগের তীর ইরানসমর্থিত হুতির দিকে
সৌদি আরবের দুটি তেল শোধনাগারে ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। সৌদি আরবের দাবি এ হামলার পেছনে রয়েছে ইরানসমর্থিত ইয়েমেনি হুতি বিদ্রোহীরা। একই সঙ্গে দেশটি একে কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ড হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে। এ খবর দিয়েছে আল জাজিরা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে তেলবাহী সৌদি জাহাজে রহস্যময় হামলার ২ দিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটলো। সৌদি আরবের তেলসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ থেকে লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত ইয়ানবু সমুদ্র বন্দরের দিকে যাওয়া একটি তেল লাইনে এ হামলা হয়। দেশটির জ্বালানি মন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ সৌদি প্রেস এজেন্সিকে এক বিবৃতিতে জানান, হামলায় অতি সামান্য ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, এই হামলা আবারো প্রমাণ করেছে যে, আমাদের উচিত ইয়েমেনে ইরানসমর্থিত হুতি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া।
কোনো পক্ষ নেয়ার ঝুঁকি নেবে না পাকিস্তান
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান উত্তেজনার বিষয়ে ঘনিষ্ঠ নজর রাখছে পাকিস্তান। তবে কোনো সংঘাত বাধলে ইসলামাবাদ কারো পক্ষে যোগ দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি। মঙ্গলবার দেশটির পার্লামেন্টে পররাষ্ট্র বিষয়ক স্থায়ী কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। আলাপকালে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে পাকিস্তান উদ্বিগ্ন। যেকোনো সংঘাত পাকিস্তানসহ গোটা অঞ্চলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট কৌশল থাকতে হবে। এসময় উপসাগরীয় অঞ্চলের চলমান উত্তেজনায় পাকিস্তান কোনো পক্ষে থাকবে না বলে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত বাধার আশঙ্কার মধ্যে কুরেশির কাছ থেকে এই বক্তব্য আসে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ইরানের কাছ থেকে হুমকির ‘বিশ্বাসযোগ্য’ তথ্য পাওয়া গেছে। তাই মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিমানবাহী রণতরী ও বোম্বার টাস্কফোর্স পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরান ওই অঞ্চলের তেলবাহী জাহাজ চলাচলকে টার্গেট করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরই মার্কিন মিত্র সৌদি আরব দাবি করে রহস্যজনক হামলায় তাদের দুটি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইসঙ্গে মঙ্গলবার সৌদি আরবের তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলার জন্য ইরানসমর্থিত হুতিদের দায়ী করেছে সৌদি আরব। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, অবস্থা যেভাবে আগাচ্ছে তাতে মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে ইরানের একটি যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সংঘাত বাধলে তা হবে পাকিস্তানের কূটনীতির জন্য পরীক্ষা। ইরানের প্রধান শত্রু সৌদি আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পাকিস্তানের। অন্যদিকে সে প্রতিবেশীকেও ক্ষুব্ধ করতে চায় না। আরব-ইরান শত্রুতার কথা উল্লেখ না করেই কোরেশি বলেন, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক রয়েছে। আমরা আমাদের সম্পর্কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই না। এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখেই পাকিস্তান তার কৌশল প্রণয়ন করবে। এ জন্য পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কাউন্সিলের সঙ্গে পরামর্শ করবে সরকার। এই কাউন্সিলে প্রবীণ কূটনীতিকরা রয়েছেন। তিনি বলেন, এটা খুবই স্পর্শকাতর ইস্যু। আমরা পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছি। পরিস্থিতি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এমন একটি কৌশল প্রণয়নের চেষ্টা করছি যেন আমাদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত এবং এই অঞ্চল অস্থিতিশীল না হয়ে পড়ে।

No comments

Powered by Blogger.