ফিটনেসবিহীন যান ‘ফিট’ করার হিড়িক

ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি টাকার আশায় পুরনো, ফিটনেসবিহীন ও ঝুঁঁকিপূর্ণ দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চে রঙের প্রলেপ লাগিয়ে ফিট করার হিড়িক পড়েছে। এ অবস্থায় প্রতি বছরের মতো এবারো ঘরমুখো মানুষের নিরাপদে বাড়ি ফেরা নিয়ে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয়। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচেতনতা ও নিরাপত্তা জোরদার করে সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান হলেও স্থায়ী সমাধানের জন্য সঠিক পরিকল্পনা নিতে হবে। আর এ ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য আইন প্রয়োগের বিধান থাকলেও নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
রাজধানী এবং এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজ ও ডক ইয়ার্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি গ্যারেজ ও ডকইয়ার্ডে চলছে গাড়ি মেরামত ও রং করার কাজ। মেরামত শেষে এসব যান দিয়েই দেশের বিভিন্ন স্থল ও নৌরুটে যাত্রী পরিবহন করা হবে ঈদের সময়। ঈদকে সামনে রেখে বেশি মুনাফা করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন অনেক পরিবহন ব্যবসায়ী। অভিযোগ রয়েছে, পুরনো বাস ও লঞ্চ ফিটনেস পরীক্ষা ছাড়া রাস্তায় নামানো, অতিরিক্ত ট্রিপ দিতে চালকদের বেপরোয়া গতি, ট্রাফিক আইন না মানার কারণে ঈদের সময় বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা।
জানা গেছে, কয়েক মাস ধরে পড়ে থাকা অচল এসব বাস দ্রুত মেরামতের কাজ চলছে জোরেশোরে। বিশেষ করে লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা দূরপাল্লার সড়ক পরিবহনের গাড়িগুলোকে রংতুলির আঁচড়ে নতুন করে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। প্রশাসনের নজরদারি এড়ানোর কৌশল হিসেবেই মেরামত ও রংতুলির এই আঁচড় দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন গ্যারেজ মিস্ত্রিরা। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাসের মেরামতের কাজ চলছে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ী-ডেমরা এলাকা ছাড়াও মাতুয়াইল, কাজলা, জুরাইন, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ এলাকার গ্যারেজ ও ডকইয়ার্ডে। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ীর কাজলা, মাতুয়াইল এলাকার প্রতিটি গ্যারেজে ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিকরা বিরামহীন কাজ করছে। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরনো বাসে নতুন সিট লাগানো, রং করা, জানালা মেরামতসহ নানা কাজ করে দিতে হচ্ছে। বাস মালিকরা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি বাস যায়। চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। ঈদের আগের দু-তিন দিন এবং ঈদের দিন এসব লোকাল বাস দূরপাল্লার রুটে নামিয়ে দেয়া হয়। জানা যায়, ঈদের আগের দিন বেশ কিছু বাস রিজার্ভ বাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আসার সময় যাত্রী পাওয়া যায় না বলে যাওয়ার সময় বেশি ভাড়া আদায় করা হয়।
রাজধানীসহ বিভাগীয় ও জেলা সদরেও বছরজুড়েই চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন অনুমোদনহীন বাস। সেসব জায়গাতেও দূরপাল্লার বাস হিসেবে চলবে রং তুলির আঁচড়ে পুরনো বাস। ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-চাঁদপুর, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ফরিদপুর, ঢাকা-মানিকগঞ্জ ও ঢাকা-নরসিংদীর মতো কাছাকাছি রুটে চালানোর জন্য রাজধানীর ভেতর চলাচলকারী ভাঙাচোড়া বাসগুলো নামানো হচ্ছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব গাড়ি শুধু দুর্ঘটনারই কারণ নয়, ঈদের ব্যস্ত মহাসড়কে বিকল হয়ে দুঃসহ দুর্ভোগেরও সৃষ্টি করে। কেননা, রাস্তায় বিকল হলে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
মাতুয়াইলের মোশাররফ বডি বিল্ডার্স নামের একটি ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো কয়েকটি বাসকে মেরামত করা হচ্ছে। ফিটনেস নেই এমন কয়েকটি বাসও সেখানে রয়েছে। সেগুলোতেও চলছে রংতুলির কাজ। ওয়ার্কশপের এক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসছে ঈদে দূরপাল্লায় যাত্রী বাহনের জন্য বাসগুলোতে নতুন রং দেয়া হচ্ছে। তার মতে, বাসগুলোর ইঞ্জিনের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বিশেষ করে দূরপাল্লায় যাত্রী বাহনের জন্য উপযোগী নয়। একই সড়কের উপর গড়ে ওঠা আরেকটি ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায়, আসছে ঈদে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে যাত্রী বহনের জন্য রাজধানীতে চলাচল করা সুপ্রভাত কোম্পানির একটি বাসে রং করা হচ্ছে। শ্রমিক রবিন জানান, আমাদের এখানে তো শুধু কাজ করতে নিয়ে আসা হয়। তবে যতদূর জানি বাসটি ঈদে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে পাঠানো হবে। এজন্যই খুব তাড়াতাড়ি কাজটি করতে হচ্ছে। পাশেই আরেকটি ওয়ার্কশপে চলছে পুরনো একটি বাসের বডি লাগানোর কাজ। এই ওয়ার্কশপের শ্রমিক রায়হান বলেন, এটি কুমিল্লার রুটে চলবে। এজন্য নতুন বডি লাগানো হচ্ছে। ২৭শে রমজানের মধ্যে যত বাস আছে সব ডেলিভারি দিতে হবে।
এদিকে লক্কড়-ঝক্কড় বাস রঙিন ও মেরামত করার পাশাপাশি চলছে ডকইয়ার্ডে পুরনো লঞ্চ মেরামতের কাজও। ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও পড়েছে আনফিট লঞ্চ ফিট করার হিড়িক। বেশ কয়েকটি লঞ্চ সারিবদ্ধ অবস্থায় সাজানো। এগুলোর কোনোটির রঙয়ের কাজ চলছে আবার কোনোটির জানালা-দরজা মেরামতের কাজ চলছে।
পারজোয়ার ডকইয়ার্ড নামের এই প্রতিষ্ঠানের মালিক হুমায়ুন কবির বলেন, এখানে তেমন কোনো কাজ হয় না। এসব লঞ্চের একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে আবার নতুন করে নির্মাণ করার জন্য ডকইয়ার্ডে আনা হয়। তবে ঈদেই ছাড়ার উদ্দেশ্যে কাজ হচ্ছে -এমনটা নয়।

No comments

Powered by Blogger.