উজাড় হতে চলেছে ‘লাউয়াছড়া’ by ইমাদ উদ দীন

চোরচক্র উজাড় করছে বন। আর পাহাড়ি টিলার গাছ ও জমি। দখলদারিত্বে মত্ত প্রভাবশালী মহল। ওদের লোলুপ দৃষ্টিতে ধ্বংস হচ্ছে ‘লাউয়াছড়া’। এখন পরিবেশ, খাদ্য আর আবাসস্থলের চরম সংকটে ভুগছে ‘লাউয়াছড়া’ জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য। নানা কারণে সংরক্ষিত এই বনটির নেই সেই জৌলুস। বলতে গেলে মানবসৃষ্ট নানা সংকটে ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাওয়া এ উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের দোরগোড়ায়। সরজমিনে উদ্যান এলাকায় গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন সম্প্রতি আবারো উৎপাত বেড়েছে গাছ চোরচক্রের। এখন প্রায়ই রাতে এই দৃশ্য চোখে পড়ছে। তাদের আশঙ্কা এভাবে চলতে থাকলে যে ক’টি বড় গাছ এখনো কোনরকমে টিকে আছে তাও উজাড় হয়ে যাবে। চোর চক্রের শকুনি দৃষ্টি ওই গাছগুলোর ওপর। তাদের জোর দাবি যেভাবেই হোক অন্তত লাউয়াছড়ার নাম টিকে রাখতে অবশিষ্ট এই গাছগুলো ওদের কবল থেকে রক্ষার। জানা গেল এই জাতীয় উদ্যানটির সংকটের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ হচ্ছে। কিন্তু বয়ে চলা সংকট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের নেই কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ। নানা কারণে দীর্ঘদিনের চলমান এ সংকটগুলো ঘনীভূত হয়ে এখন মহা হুমকিতে পড়েছে ওখানকার নানা দুর্লভ প্রজাতির বন্য প্রাণীর বাসস্থান, জীবন জীবিকা ও পরিবেশ। আর একারণেই দিন দিন পরিসংখ্যানও কমছে ওখানে ঠাঁই নেওয়া বিশ্বের বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের। এ সংকট উত্তরণে (মাঠ জরিপ ও সমীক্ষা শেষে) সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা নানা পরামর্শ ও মতামত দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। নানা অজুহাতে লোক দেখানো দায়সারা গোচরের দু-একটি কর্মসূচি পালন করেই তারা ক্লান্ত। কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতায় বিলীনের পথে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ও বনজসম্পদ। এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া উদ্যানটি এখন চরম সংকট ও ঝুঁকিতে। এর অন্যতম কারণ উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ফলদ ও বনজ গাছ চুরি, বাঁশ চুরি, ভূমি বেদখল, গ্যাসকূপ খনন, বন্যপ্রাণীর খাবার, আবাসস্থল ও অবাধ বিচরণের জায়গা কমে যাওয়া ও শুষ্ক মৌসুমে খাবার পানি সংকট। উদ্যানের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথ থাকা। তাছাড়া লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে বৈদ্যুতিক তার ও খুঁটি টানানো। গবেষকদের অভিমত এ কারণেই বন্যপ্রাণীদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। ওরা ভয়ে ভীত থাকছে আর যার ফলে ওরা আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগবালাইয়ে। প্রায় সময় দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণী মারাও যাচ্ছে। বনের ভেতরে চাষাবাদ, অত্যধিক পর্যটকের চিৎকার আর হৈ হুল্লোড়। বিব্রত ও ভীত হয়ে নিজেদের আবাস্থল ছেড়ে অন্যত্র সরতে চায় ওখানকার বন্যপ্রাণী। দীর্ঘদিন থেকে এসব সমস্যা চলমান থাকায় সব মিলিয়ে এখন ওখানকার বাসিন্দাদের চরম সংকটাপন্ন অবস্থা দেখা দিয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করে এমন কয়েকটি সংগঠনের জরিপ বা গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতায় এমন সব তথ্য দিচ্ছেন তারা। তারা উদ্যানটির সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্যপ্রাণী বাঁচিয়ে রাখতে বয়ে চলা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন। দ্রুত এ সংকটগুলোর স্থায়ী সমাধান না হলে ভয়াবহ বির্পযয়ের বিপদ সংক্ষেতও দিচ্ছেন তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন আগের লাউয়াছড়ায় যে বনজঙ্গল আর লতাগুল্ম ছিল তা এখন আর নেই। এরজন্য দায়ী স্থানীয় একটি প্রভাবশালী বনখেকো চক্র। উদ্যানটিতে এখন শুধু নেই আর নেই। ঐতিহ্যবাহী ক্লোরোফর্ম গাছ নেই। নেই চন্দন, আগর, সেগুন, চাপালিশসহ নানা প্রজাতির বৃহদাকার গাছ। প্রতিনিয়তই গাছ ও বাঁশ চুরি হওয়াতে বন উজাড় হচ্ছে। ফাঁকা বনে চুরি হওয়া গাছের সাক্ষী হয়ে থাকছে গাছের মোথা। গাছ চোররা অভিনব নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রতিনিয়তই গাছ চুরি অব্যাহত রাখলেও তাদের প্রতিহত করতে নেই সমন্বিত পদক্ষেপ কিংবা কৌশল। বরং, অস্ত্র ও পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভাগের। তাই চোর চক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না উদ্যানটির ফলদ ও বনজ মূল্যবান গাছ। অথচ ওই গাছগুলোই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রাখছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা অভিযোগ করে বলছেন ওই চোর চক্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা- কর্মচারীর। তাদের সঙ্গে আঁতাত করেই চুরি হয় ওখানকার মূল্যবান বনজ সম্পদ। তারা আরো বলছেন, লাউয়াছড়া উদ্যানের মধ্যেই দু’টি খাসিয়া পুঞ্জির লোকজনের বসবাস। তারা পান চাষের নামে ছোট বড় বনজ ও ফলদ গাছের অগ্রভাগ ও ডালপালা কেটে গাছের জীবনচক্র নষ্ট করছেন। যেটি বন্যপ্রাণী ও বনের মারাত্মক ক্ষতি করছে বলে অভিযোগ তুলছেন তারা। এলাকাবাসী জানালেন বনে খাবার সংকটে রাতে শিয়াল, শূকর, বানর, হরিণ, অজগরসাপসহ ওখানকার বনের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী খাদ্যের সন্ধানে আশপাশের গ্রামগুলোতে আসে। অভুক্ত এ প্রাণী খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে এসে বিনষ্ট করে তাদের ক্ষেতের ধান ও ফসলের মাঠ। অভুক্ত এই প্রাণীদের হিংস্র আচরণে আশপাশের লোকজন অতিষ্ঠ। তারা জানালেন, প্রাণীদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ লোকজনের হাতে অনেক প্রাণী মারাও যায়। এছাড়া ১৯৯৭ সালে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে গাছগাছালি মরে যাওয়ায় প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ কারণে অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে ওখানকার প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। তা ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে শুরু করলেও চোরচক্রের লোলুপ দৃষ্টিতে তা সম্ভব হচ্ছে না। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বনজঙ্গল সাবাড় করছে মানুষ। আর এ কারণেই ধ্বংস হচ্ছে ওখানকার জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতি। পরিবেশবাদী সংগঠন বাপা মৌলভীবাজার জেলা সমন্বয়ক আ.স.ম ছালেহ সুহেল ও জেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাংবাদিক সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন একটি প্রভাবশালী চক্রের খপ্পরে ধ্বংস হচ্ছে লাউয়াছড়া। প্রতিনিয়তই গাছ, বাঁশ ও মূল্যবান বনজসম্পদ চুরি হলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। তাদের এমন আচরণেই হুমকির মুখে লাউয়াছড়া। তাই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বাঁচিয়ে রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ তাদের। বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিভাগ ও জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা স্থানীয় মানুষের তাদের ওপর আনীত নানা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও লাউয়াছড়ার ঐতিহ্য রক্ষায় তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে স্থানীয় জনগণকে নিজেদের স্বার্থে পরিবেশ, প্রাণী ও বনজসম্পদ টিকিয়ে রাখতে তাদের কাজে সহযোগিতার অনুরোধ তাদের। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গা নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্যময় বন গবেষণা কেন্দ্রসহ এই উদ্যানে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণীর বিচরণ। লাউয়াছড়ায় ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.