বিজ্ঞাপনে ডলার পাচার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার

প্রযুক্তির যুগে গুগল-ফেসবুক এখন প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখন সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেখতে আগ্রহী। দিন দিন এর ব্যবহার বাড়ছে। বাড়ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। এ সুযোগে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে দেশ থেকে কোটি কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে ইন্টারনেট জায়ান্ট এ দুই প্রতিষ্ঠান। বিপুল অঙ্কের অর্থ কামিয়ে নিলেও সরকারকে এক পয়সাও রাজস্ব দিচ্ছে না। বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের অর্থ ক্রেডিট কার্ডে ডলারে পরিশোধ করছেন। প্রতি বছর ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন বাবদ কত ডলার বিদেশে যাচ্ছে তার সঠিক হিসাবও নেই। তবে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের রাজস্ব ও শুল্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গুগল চুক্তি করতে বাধ্য হয় এবং এমনকি যুক্তরাজ্যকে ১০ বছরের বকেয়া রাজস্ব বাবদ ১৩ কোটি পাউন্ড পরিশোধও করে গুগল। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফর্মেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার যুগান্তরকে বলেন, ইচ্ছে করলেই প্রযুক্তিকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। তেমনি ডিজিটাল বিজ্ঞাপন রোধ করা যাবে না। তবে ফেসবুক-গুগলের সঙ্গে আলোচনা করে সরকার এখান থেকে কিভাবে রাজস্ব আদায় করতে পারে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। জানা গেছে, গুগল ও ফেসবুকের বাংলাদেশে কোনো অফিস না থাকায় তারা দেশের প্রচলিত আইনকে তোয়াক্কা করছে না। অথচ যে কোনো দেশে ব্যবসা পরিচালনার প্রধান শর্ত হচ্ছে ওই দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এ দুই ইন্টারনেট জায়ান্ট কত আয় করছে সেটি প্রকাশ করছে না বা করার প্রয়োজনও মনে করছে না। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে হলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও তার সঙ্গে ৪ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয়। গুগল-ফেসবুক এসব না মানায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব সরকার শুধু হারাচ্ছেই না পাশাপাশি বিপুল অঙ্কের টাকা ডলারে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) গুগল ও ফেসবুকের এ অর্থ পাচারের কাহিনীর বর্ণনা দিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি ধারণাপত্র পৌঁছে দেয়। সেখানে বলা হয়েছে, একজন বিজ্ঞাপনদাতা যদি ডিজিটাল বিজ্ঞাপনে এক ডলার ব্যয় করেন তার ৬০ ভাগই (৬০ সেন্ট) চলে যাচ্ছে গুগল ও ফেসবুকে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের প্রবৃদ্ধিতে সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে ফেসবুক। ২০১৬ সালের প্রথম প্রান্তিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের প্রবৃদ্ধি পায় ৫৭ ভাগ।
এ সময় বিজ্ঞাপনের আকার ৩৩০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫২০ কোটিতে। ২০১৭ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৫০ ভাগে। তবে মোট আয় ৪৪.৮ ভাগ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩২ কোটি ডলারে। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য ছাড়াও আয়ারল্যান্ড এবং জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ গুগল ও ফেসবুককে জবাবদিহির মধ্যে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে গুগলের চুক্তি সই হয়। তারা বকেয়াও পরিশোধ করেছে যুক্তরাজ্যকে। যুক্তরাষ্ট্রও তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনেছে। ফলে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য দেশ থেকে তাদের আয়ের বড় একটি অংশ পাঠিয়ে দিচ্ছে ট্যাক্স হ্যাভেন (শূন্যকর) হিসেবে খ্যাত বারমুডায়। যদিও সেখানে গুগলের কোনো অফিস নেই। ২০১২ সালে ফেসবুকের আয়কর বিবরণীতে দেখা যায়, ফেসবুক তাদের আয়ের ৬৪.৫ কোটি পাউন্ড করস্বর্গখ্যাত কেম্যান আইল্যান্ডে পাচার করেছে। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপন থেকে তাদের যে রাজস্ব আসে তা এখানে জমা হয়। ২০১২ সালে ফেসবুক ১৫০ কোটি পাউন্ড আয় করলেও আইরিশ সরকারকে কর দেয় মাত্র ৪৪ লাখ পাউন্ড। আয়ারল্যান্ডে রয়েছে ফেসবুকের সহযোগী অফিস। কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যেতে ফেসবুক ‘ডাবল আইরিশ’ নামের একটি জটিল ওয়েব সাবসিডিয়ারি পরিচালনা করে। তারা আমেরিকান বহুজাতিক সংস্থাগুলোর নিয়োজিত বলে দেখানো হয়েছে। গুগল-ফেসবুকে সরাসরি বিজ্ঞাপন দেয় এমন একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিপণন বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত সাশ্রয়ী ও অধিক কার্যকর হওয়ায় গুগল-ফেসবুকে তারা বিজ্ঞাপন দেয়। কম খরচে পণ্যের বিজ্ঞাপন নির্দিষ্ট শ্রেণীর ক্রেতা-দর্শকের কাছে পৌঁছে দেয় গুগল-ফেসবুক।
অথচ ওই অর্থ খরচ করে কোনো অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া সম্ভব নয়। আর তাতে ভালো সাড়া পাওয়া যায় না। কারণ একজন ক্রেতা বা দর্শক সব সংবাদপত্র ও অনলাইনের পাঠক নন। এদিক থেকে গুগল-ফেসবুক ক্রেতা-দর্শককে বিজ্ঞাপন দেখাতে বাধ্য করে। দেশীয় প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভোক্তার কাছে পণ্য নিয়ে পেঁঁছানো যায়। তবে ডিজিটাল প্লাটফর্মে বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এ কারণে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন প্লাটফর্ম বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক খবরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিডিয়া ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ এমের তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে চীন বাদে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাবদ বৈশ্বিক ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে। ২০১৮ সালে এ ব্যয় চলতি বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে। ডিজিটাল বিজ্ঞাপন খাতে গুগল ও ফেসবুকের আধিপত্যের কারণে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দুটি ডিজিটাল ডুওপলি বা দ্বৈত আধিপত্য বিস্তারকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রেডিট কার্ড বা হুন্ডির মাধ্যমে ফেসবুক বা গুগলে বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করা যাবে না। এটি রোধ করার মতো কারিগরি ক্ষমতাও খুব একটা নেই। ভবিষ্যতে অনলাইন বিজ্ঞাপনের বাজার আরও বাড়বে। তবে সঠিক নজরদারির মাধ্যমে পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব।
ফলে এ খাতে এখনই সরকারকে দৃষ্টি দিতে হবে। ২০১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিদেশি মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়ার একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, বিদেশি ইলেকট্রুনিক বা অনলাইন মিডিয়ায় বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বাবদ বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়ের ক্ষেত্রে চুক্তি ও ইনভয়েসের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের যথার্থতা এবং সঠিকতা নিরূপণসহ প্রযোজ্য করাদি কর্তন করতে হবে। অথচ বিগত সময়ে এ নির্দেশনা মেনে কোনো প্রতিষ্ঠান বিদেশে টাকা পাঠায়নি। কথা হয় বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসানের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে অফিস না করলে গুগল-ফেসবুককে প্রচলিত আইনের আওতায় আনা সম্ভব নয়। এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সঠিকভাবে অনলাইন মার্কেটিং করতে না পারার কারণে দেশের ই-কমার্স সাইটগুলো পিছিয়ে পড়ছে। বেসিসের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ বিদেশে পাঠানো যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এর চেয়ে বেশি অর্থ খরচ করছে, যেমন উবার। এসব বিষয়ও ভাববার সময় এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.