তুরস্ক পেছায়, আমরা নই!

গত বছরের নভেম্বরের কথা। আমরা অনেকে খবরটি হয়তো খেয়াল করিনি। তবে তা বিশ্ব সংবাদের শিরোনাম হয়েছিল। কিশোরী কিংবা বালিকাদের ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি ধর্ষিতাকে বিয়ে করলে অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পাবেন—এ রকম একটি আইনের খসড়া নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনা চলছিল। পার্লামেন্টে খসড়াটির প্রথম পাঠ অনুমোদনের পর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উত্থাপনের প্রস্তুতির সময়ে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে প্রতিবাদে নামলেন।
আইনের খসড়ায় ছিল কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বা কিশোরীর সঙ্গে ভীতি প্রদর্শন কিংবা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক না হলে তাকে ধর্ষণের অপরাধে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। বরং তা সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সম্পর্ক হিসেবে গণ্য হবে। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং নারী সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এই আইন ধর্ষণকে উৎসাহিত করবে। অবশেষে ব্যাপক জনবিক্ষোভের মুখে সরকার সেই আইন প্রণয়ন থেকে পিছিয়ে আসে। যে দেশ এই সর্বনাশা পথ থেকে ফিরে এসেছে সেটি হচ্ছে সুলতান নামে অধিক পরিচিত প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের দেশ তুরস্ক। দেশটির পার্লামেন্টে এখন এরদোয়ানের দল ইসলামপন্থী একেপির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং গত বছরের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাঁর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। অন্যান্য অনেক দেশের মতোই তুরস্কেও মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। কিন্তু আইন থাকলেও বাল্যবিবাহের চল ব্যাপক। যে কারণে ওই আইন তৈরির উদ্যোগে নাগরিক সমাজে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গুমোট অস্বস্তির মধ্যেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হতে থাকে। তুরস্কের প্রস্তাবিত আইনটি ঘিরে বিতর্কের অন্য আরেকটি দিকও উল্লেখযোগ্য। ওই আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ২০১৬ সালের ১১ নভেম্বরের আগে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো মেয়েকে যৌন নির্যাতনের জন্য অভিযুক্ত পুরুষ ধর্ষিতার সম্মতির ভিত্তিতে তাকে বিয়ে করলে অপরাধের দায় থেকে তাকে মুক্তিদান। আইনটি অনুমোদিত হলে প্রায় তিন হাজার পুরুষ এই দায়মুক্তির সুবিধা পেতেন (ফিউরি অ্যাট টার্কিশ বিল টু ক্লিয়ার মেন অব চাইল্ড সেক্স অ্যাসাল্ট ইফ দে ম্যারি ভিকটিমস, দ্য গার্ডিয়ান, ২২ নভেম্বর ২০১৬)।
তুর্কি আইনমন্ত্রী বেকির বোজদাগ আইনটির পক্ষে তাঁর যুক্তি দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাল্যবিবাহ আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং যেসব পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাঁরা ধর্ষক বা যৌন আগ্রাসী নন। আইনটির বিরোধিতাকারীরা অবশ্য আইনমন্ত্রীর ওই বক্তব্য মানতে পারেননি। আইনটির খসড়ায় ভবিষ্যতের অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য না থাকলেও প্রতিবাদকারীরা ভূতাপেক্ষ অপরাধের দায়মুক্তি মানতে রাজি ছিলেন না। তাঁদের আশঙ্কা যে ভবিষ্যতেও অতীতের দৃষ্টান্তকে কাজে লাগানো হতে পারে। তুরস্কের সর্বাধিক বিক্রীত উপন্যাসের লেখিকা এলফ সাফাক সে সময়ে বিবিসিকে বলেছিলেন, তাঁর প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ‘সম্মতি’ শব্দটিতে। পরিবারকে ভয় দেখিয়ে অথবা টাকাপয়সা দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহারের সম্মতি আদায় করা খুবই সহজ। আন্দোলনকারীদের যুক্তি হলো, এর ফলে শিশুটি আবারও অন্যায়ের শিকার হবে। আশা করি, পাঠক এতক্ষণে আমাদের সদ্য পাস হওয়া বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের সঙ্গে তুরস্কের অভিজ্ঞতার মিল-অমিলগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছেন। আইনটি পাস হওয়ার পর আমাদের একজন নারীনেত্রী, ক্ষমতাসীন জোটের ছোট শরিক, জাসদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার প্রশ্ন রেখেছেন, ‘আমার কন্যাকে কি তবে ধর্ষক, অপহরণকারীর কাছে বিয়ে দিতে হবে?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তবে’ যুক্ত করে আইন না করে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে (আমার কন্যাকে কি তবে ধর্ষকের কাছে বিয়ে দিতে হবে? প্রথম আলো অনলাইন, ২ মার্চ ২০১৭)। জাসদ নেত্রী নিজে যা বললেন তাঁর নেতা কিন্তু তেমনটি বললেন না।
ওই একই সেমিনারে জাসদ নেতা ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বরঞ্চ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন যে মূল আইনের প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে সমালোচকেরা নাকি শুধু বিশেষ বিধানের দিকে নজর দিচ্ছেন। তিনি বিশেষ ধারার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেছেন যে একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর সে যদি অন্তঃসত্ত্বা হয় তাহলে মেয়েটির কী হবে? এ রকম ক্ষেত্রে আদালতের আদেশে দুই পরিবারের ‘সম্মতি’তে বিয়েই সমাধান। এর আগে জাতীয় সংসদে যেদিন বিলটি পাস হয়, সেদিনও সরকারের শরিক জাতীয় পার্টির কয়েকজন সদস্য আইনটির জন্য জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেছিলেন। এসব সাংসদদের কাছে কেউ অবশ্য এখনো পাল্টা প্রশ্ন রাখেননি যে আইনটি পাসের সময় সংসদে আপনার ভোটটি প্রস্তাবের বিপক্ষে রেকর্ড হলো না কেন? কারণ, তাঁরা জানেন যে ভোটটি বিপক্ষে দিলে সরকারে থাকা আর সম্ভব হবে না। তাঁরা বিপক্ষে ভোট দিলেই যে আইনটির অনুমোদন ঠেকে থাকত তা নয়, কিন্তু তাঁদের যে বিরোধী দলের তকমা বজায় রাখার কোনো নৈতিক অধিকার নেই, সে কথাটি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া ভালো। এ ধরনের সুবিধাবাদী খিচুড়ি রাজনীতির দেউলিয়াত্ব তুলে ধরার দায় সংবাদমাধ্যমের রয়েছে। আইনের বিশেষ বিধানের দিকে নজর না দিয়ে যদি মূল আইনটির প্রসঙ্গ আলোচনা করি তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে—এই আইনে আমরা নতুন কী পেলাম। আর নতুন যা পেলাম তাতে কি অবস্থার উন্নতি ঘটবে নাকি বাল্যবিবাহের ঝুঁকি বা প্রবণতা বাড়বে? যদি ঝুঁকি বাড়ে তাহলে তাকে কি অগ্রগতি বলা যাবে, নাকি পশ্চাদ্মুখী বলতে হবে? এই আইনটি হওয়ার আগে বাল্যবিবাহ নিরোধে দেশে কি কোনো আইন ছিল?
তাতে বিয়ের ন্যূনতম বয়স কী ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাচ্ছে, দেশে বাল্যবিবাহ নিরোধের ক্ষেত্রে কোনো আইনগত শূন্যতা ছিল না। দ্য চাইল্ড ম্যারেজ রেস্ট্রেইন্ট অ্যাক্ট, ১৯২৯ নামে একটি আইন ছিল, যা ১৯৩০ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর ছিল। ওই আইনের ১৯৮৪ সালে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সংশোধনী এনে শিশুর সংজ্ঞায় ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়স ২১ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচে নির্ধারণ করা হয়। ওই আইনে সাজার পরিমাণ ছিল খুবই সামান্য, যা বর্তমান যুগে প্রতিরোধক হিসেবে কাজে আসছিল না। ফলে সাজার পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা থেকে আইনটির সংশোধন যে জরুরি ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ওই আইনে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের ‘সম্মতি’র অবকাশ ছিল না। আর ধর্ষণের মতো অপরাধের চিকিৎসা বা ওষুধ হিসেবেও তখন আইনটির কথা কেউ ভাবেনি। এখন মন্ত্রীদের কারও কারও কথায় স্পষ্টতই বোঝা যায় শিশু ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ মোকাবিলায় ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা হিসেবে এই আইনে বিশেষ বিধান যুক্ত করার ভুল পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর চিত্র কি আলাদা কিছু? জাতিসংঘের শিশু তহবিল, ইউনিসেফের ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে যত বাল্যবিবাহ হয় তার প্রায় ৪২ শতাংশই হয় দক্ষিণ এশিয়ায়। আর ভারতে হয় বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাল্যবিবাহ (সূত্র: এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: প্রোগ্রেস অ্যান্ড প্রসপেক্টাস)। ওই পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বেশি। তবে গত দুই দশকে এই হার একটু একটু করে কমছিল। পরিসংখ্যান আরও বলছে যে বাল্যবিবাহের শিকার প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে মেয়ে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী অধিকারের নীতির সঙ্গে বাল্যবিবাহের এই বিশেষ বিধান কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ নয়। ঢাকায় ইউনিসেফের প্রতিনিধি এডওয়ার্ড বেগবেইডার জানিয়েছেন,
বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যকার সময়টিতে। এখন আশঙ্কা এটি আবার বাড়বে এবং হয়তো নাটকীয় হারে। সামাজিক সম্মান, ধর্মীয় মূল্যবোধ, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতাসহ নানা ধরনের জানা এবং অজানা কারণে এটি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দাঁড়াবে সেই সব বখে যাওয়া ছেলে, যারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে অথবা পরিবারের সম্মতি না পেয়ে সবচেয়ে খারাপ পথটি বেছে নেওয়ার মতো বেয়াড়া। আর এ ধরনের বখে যাওয়া বেয়াড়া বা দুর্বৃত্তদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব হয় না। আইনে বিশেষ বিধানের পক্ষে এমন যুক্তির কথাও শোনা গেছে যে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ১৮-এর নিচে এমনকি ১৬ বছরেও অনেক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কথিত অনাকাঙ্ক্ষিত সামাজিক সমস্যা এড়াতে পারিবারিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিশেষ ছাড় দিলে খুব বড় একটা সমস্যা হবে না। এটি যে একটি মন্দ যুক্তি সেটা তাঁরা ভালোই জানেন। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সামাজিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ আলাদা। সেখানে বিয়ের বাইরেও কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হলে তা নিয়ে সামাজিক সমস্যা হয় না। ক্ষমতার রাজনীতিতে যেখানে হেফাজত অথবা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার বৃত্তে প্রধান প্রধান দলগুলো বাঁধা পড়ে আছে, সেখানে পাশ্চাত্যের মতো অবাধ যৌনতার সমাজকে দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনার অবকাশ কই।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.