চলছেই রাজনৈতিক মেগাসিরিয়াল

যখন শ্রমিক ধর্মঘট ওরফে অবরোধে সারা দেশে জনগণের পা মাটিতে গিয়ে ঠেকেছে, তখন আমাদের নৌপরিবহনমন্ত্রী কাম শ্রমিকনেতা শাজাহান খান বললেন, ‘ধর্মঘট কই, শ্রমিকেরা তো অবসরে গেছে।’ মন্ত্রীর কাছে অবসরে যাওয়াই যদি এ রকম হয়, তাহলে ধর্মঘট-অবরোধ-হরতালে না জানি কী হবে! মনে পড়ল সুকুমার রায়ের বই হযবরল-এর ছড়া, ‘ঠাস্ ঠাস্ দ্রুম্ দ্রাম্, শুনে লাগে খটকা—
ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!’
একজন শ্রমিকের দুঃখজনক মৃত্যু দিয়ে অবসর নাটক আপাতত শেষ। কিন্তু যে মানুষটি মারা গেলেন, তাঁর পরিবারের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস শুরু হলো কেবল। আমরা ভুলে যাব, নতুন কোনো ঘটনা এসে উত্তেজিত করে রাখবে আমাদের। সুন্দরবন আন্দোলন ঢেকে দিল নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। গ্যাসের দাম বাড়ার ক্ষোভ গৌণ হয়ে গেল শ্রমিক ধর্মঘটজনিত গণ-অসহায়ত্বে। অপেক্ষমাণ সারি থেকে এখন আবার উঠে এসেছে উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের ভাস্কর্য নিয়ে বিবাদ। আমাদের জাতীয় জীবন যেন এক রাজনৈতিক মেগা সিরিয়াল; প্রতিটি পর্বেই নতুন নতুন চমক। ধর্মঘট শেষ না হতেই ঢাকার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার নিরাপত্তাপ্রহরীদের বিরাট গন্ডগোল হয়ে গেল। তার আগে গ্যাসের দাম বাড়ার প্রতিবাদে বামপন্থীদের হরতাল। তারও আগে সাংসদ মনজুরুল হত্যার অভিযোগে সাবেক সাংসদ কাদের খানের নাটকীয়ভাবে আটক হওয়া এবং গণমাধ্যমে তৎসম্পর্কিত গল্প–কাহিনির প্রচার। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনীতে কোনো নিস্তরঙ্গ সুদিন পাওয়ার উপায় নেই। আমাদের কোনো দিন নিরুত্তেজিত থাকা কঠিন। কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের একটা গল্পের নাম ‘প্রতিদিন একটি রুমাল’। সেখানে মনমরা এক ধনীর দুলাল জীবনে আনন্দের খোঁজে প্রতিদিন একটি করে ‘নারী শিকার’ করে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনকার জীবন বিভিন্নভাবে শিকার হওয়ার গল্পে ভরপুর। একটি ঘটনা এসে আরেকটি ঘটনাকে সরিয়ে দেয়। সেই শাহবাগ আন্দোলন দিয়ে শুরু।
তারপর এল হেফাজতের মতিঝিলপর্ব। তারপর এল পেট্রলবোমার মৌসুম। পেট্রলবোমা শেষ হতে না হতেই শুরু হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার অঘটন। সেটা চলতে চলতেই এল জঙ্গিবাদের নতুন পর্যায়। ইত্যবসরে নিয়মিতভাবে সড়ক দুর্ঘটনা, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু ঘটেই চলছে। এখানে কোনটি দুর্ঘটনা আর কোনটি সচেতন অবহেলার ফল, তা যেমন প্রমাণ করা যায় না, তেমনি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত লোকজনের প্রকৃত অপরাধেরও উন্মোচন ঘটে না। এ ধরনের মৃত্যু মেগা সিরিয়ালের মতো চলতেই থাকে। এহেন গোলমালে কোনো কিছুরই মীমাংসা হয় না, কোনো ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয় না। আর বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা হয়েছে লুইস ক্যারলের বিখ্যাত রূপকথা ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর অ্যালিসের মতো। ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঢোকামাত্রই অ্যালিসকে বিবিধ বিপদে কেবলই দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। অ্যালিসের সঙ্গী বিড়ালটি তাকে তখন বোঝায়, ‘খুকুমণি, এখানে আমাদের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলে যত জোরে পারা যায় তত জোরে দৌড়াতে হবে। আর তুমি যদি কোথাও পৌঁছাতে চাও, তাহলে এর থেকে দ্বিগুণ বেগে ছুটতে হবে।’ ঘটনা ঘটে আর আমরা যথাসাধ্য প্রতিক্রিয়া করে যাই। একটি ঘটনার সুরাহা না হতেই আরেকটি অঘটন ঘটে বসে। তখন আবার সেটা নিয়ে সরব হই। সেটার গোড়া ধরতে না ধরতেই চলে আসে আরেক উত্তেজনা। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারের প্রধান মনীষী আবুল ফজল বোধ হয় এ জন্যই বাংলাকে বলেছিলেন বুলঘাকখানা বা চির অশান্তির দেশ।
এ রকম পরিস্থিতিতে দূরদর্শী চিন্তা বা বড় পরিকল্পনা করা কঠিন। মানুষ হয়ে পড়ে মুহূর্তবাদী। প্রতিদিনকার জীবনযন্ত্রণা তার উদ্যম, তার জীবনীশক্তি শুষে নেয়। একসময় তারা হয়ে পড়ে উত্তেজনাভুক। পরিবর্তনের চিন্তা ও শক্তি তারা হারিয়ে ফেলে। দিনের পর দিন এমন উদ্বেগ, হতাশা, বিরক্তি জমতে জমতে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রকম বিকারের জন্ম হয়। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাংলাদেশে ৬৩ লাখ ৯১ হাজারের বেশি মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ১ শতাংশ। এ ছাড়া উদ্বেগজনিত সমস্যায় ভুগছে ৬৯ লাখ মানুষ। এটা মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। মাত্রাটা বিপজ্জনক। আমরা রাষ্ট্র-রাজনীতি নিয়ে যত চিন্তিত, সমাজ জিনিসটা আমাদের মনোযোগে ততটা থাকে না। কিন্তু আমাদের বাঁচা-মরা, ভালো-মন্দ সব সমাজ সমতলেই ঘটে। সেই সমতলে কিছু একটা ঘটছে, যা জীবনবিরোধী; যা সুস্থ নয়। সামাজিক সহিংসতাও মাত্রা ছাড়াচ্ছে। যখন মা বা বাবা কিংবা নিকটাত্মীয়রা শিশুসন্তানকে হত্যা করে, তার ব্যাখ্যা সরল চিন্তা দিয়ে হওয়ার নয়। বন্ধু বন্ধুকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। নিষ্ঠুরতা আর শত্রুতার জলবায়ুতে চলাফেরা করতে হচ্ছে সবাইকে। এগুলো গড়পড়তা অপরাধমূলক হত্যা নয়। অনেক সময় ঘাতক ও নিহত ব্যক্তি উভয়ই জীবন দিয়ে কোনো না কোনো দুঃসহ যন্ত্রণার ইতি টানছেন। হিংসা, অসহায়ত্ব, হঠাৎ জেগে ওঠা রাগ এবং স্বার্থচিন্তা থেকে হত্যা হচ্ছে। এগুলো একধরনের সামাজিক হত্যাকাণ্ড, যার কার্যকারণ ও প্রকাশ হয়তো বিচিত্র। আবার এগুলোর মধ্যে আমাদের সময়ের গনগনে সামাজিক সহিংসতার আঁচ পাওয়া যায়। কখন দুর্দশায় থাকা দুজন মানুষের মধ্যে পরস্পরকে হত্যার ইচ্ছা জেগে ওঠে, তা নিয়ে কাজ করেছিলেন আলজেরীয় বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক ফ্রাঞ্জ ফ্যানো। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে দার্শনিক ও মনস্তত্ত্ববিদ। সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানসিক গন্ডগোলের সম্পর্ক দেখানোয় তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি ছিলেন আলজেরিয়ার একটি হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের প্রধান।
 আলজেরিয়ায় তখন চলছে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক দুঃশাসন। তাঁর কাছে চিকিৎসার জন্য আসা লোকজনের ওপর গবেষণা থেকে তিনি একটি বই লেখেন, ব্ল্যাক স্কিন, হোয়াইট মাস্ক (১৯৫২)। তাঁর বিখ্যাত রেচেড অব দ্য আর্থ বইতেও (১৯৬১ সালে প্রকাশিত বইটির বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়) প্রসঙ্গটা এসেছে। সেটা হলো দীর্ঘদিন চাপ, অবদমন, অসম্মান ও নির্যাতনের পরিবেশে থাকলে সমাজে পারস্পরিক হিংসা বেড়ে যায়। ফ্যানো দেখিয়েছেন, যখন মনে হচ্ছে দেশ তুলনামূলক শান্ত, তখন জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক অপরাধপ্রবণতা দেখা দিচ্ছে। আবার যখন স্বাধীনতাযুদ্ধ এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কমে যাচ্ছে সামাজিক অপরাধ। সমাজ মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলা যায় ট্রান্সফারড অ্যাগ্রেশন বা স্থানান্তরিত ক্রোধ। এটা এমন এক মানসিক দশা, যখন আপনি সমস্যার মূল কারণে হাত দিতে না পেরে বা তা খুঁজে না পেয়ে চারপাশের ওপর আক্রোশ বোধ করবেন। তাই এড়িয়ে গিয়ে ভালো থাকার উপায় নেই। প্রতিদিনের উত্তেজনার মধ্যে মন ডুবিয়ে রাখার বাইরে আসতে হবে। হ্যাঁ, আমাদের পরিস্থিতির চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে। নাকের ডগার বাস্তবতার চেয়ে আরও বেশি দূর দেখতে পারতে হবে। কারা করবে সেটা? সে, তুমি, আমি করব। আমি-তুমি-সে মেলানো আমরা যদি এটা করি, তাহলে আমাদের নেতা–নেত্রী, প্রতিষ্ঠানের প্রধানজনেরাও সেই আমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে বাধ্য হবেন। ওই অ্যালিসের বিড়ালের ভাষায়, ‘তুমি যদি কোথাও পৌঁছাতে চাও তাহলে এর থেকে দ্বিগুণ বেগে ছুটতে হবে।’
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
faruk.wasif@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.