আর কত অমানবিক হবে মানুষ?

মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বেঁচে থাকলে রবীন্দ্রনাথ আজও কি অকুণ্ঠচিত্তে তা বলতে পারতেন? হয়তো পারতেন, হয়তো পারতেন না। তবে ঘোর   অন্ধকার এ সময়ে অমানবিকতা প্রতিদিন নিজের বিজয় ঘোষণা করছে। সভ্যতার এ যেন এক নিষ্ঠুর পরিহাস। শিশু হত্যার ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদ হচ্ছে। কারণে-অকারণে মানুষ হত্যা করছে মানুষকে।
আধুনিক রাষ্ট্র ক্রমেই মানুষ থেকে মানুষকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। নগরের ইমারতের নিচে চাপা পড়ছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা-আবেগ। একসময় যৌথ পরিবার আজ ভেঙে খানখান। ফ্ল্যাট সংস্কৃতিতে পাশাপাশি বাসার মানুষ যোজন যোজন দূরত্বে। উত্তরায় গ্যাস বিস্ফোরণে একই পরিবারের তিনজন নিহত হওয়ার মর্মস্পর্শী ঘটনা অনেককেই নাড়া দিয়েছে। তবে ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া আক্তার তার স্বজনদের কাছে যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে আঁতকে উঠবেন যে কেউ। খালাতো ভাই নওশাদ জামান সুমাইয়ার এ ভাষ্য রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করেছেন। দগ্ধ পরিবারটিকে কেউ সহযোগিতা করতে এগিয়ে না যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। স্বজনদের সঙ্গে আলাপকালে সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘চিৎকার দিয়ে নামতাছি- আগুন লাগছে সাহায্য করেন। বাঁচান বাঁচান। গায়ে তো আগুন। তিন আর চার নম্বর ফ্লোর থেকে দরজা খুলছে। আমাদের দেখে দরজা বন্ধ করে দিছে। স্পষ্ট মনে আছে। সাত তলা থেকে নামছি। তিন তলার লোকরা একটা তোষক দিয়ে যদি জড়াইয়া ধরতো। একটা তোষক না হয় পুড়তো। আমার বাচ্চাগুলো তো বাঁচতো।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া অডিও রেকর্ডে সুমাইয়া আক্তারকে বলতে শোনা যায়, ‘বাসার চুলায় গ্যাসের পাওয়ার কম ছিল। বাসায় যখন উঠলাম সিলিন্ডার গ্যাস ছিল না। তিন দিন কিনে খেয়েছি খাবার। তারপর মিস্ত্রি এসে রাইজার বাড়িয়ে পাওয়ার ঠিক করে দিছে। তার পরও গ্যাস লিক করতো। গ্যাসের গন্ধ পাইছি। জানালা খোলা রাখতাম।’ সুমাইয়া বলেন, ‘গ্যাসের গন্ধ পেয়ে রাতেও তার স্বামী মোমবাতি জ্বালিয়ে চেক করেছেন। পরে বললো মনে হয় ওপরে ছাদ থেকে আসতেছে। চুলা অল্প জ্বালিয়ে চায়ের পানি দিছি। ওর আব্বু বললো ঘরে গ্যাসের গন্ধ আসছে, ফ্যানটা ছেড়ে দিই। ফ্যান ছেড়ে জানালা খুলে দেয়ার জন্যে। জায়ান ওর বাবার কোলে। যেই ফ্যানটা ছেড়ে দেবার পরে দাউ দাউ করে আগুন। সেকেন্ডের মধ্যে, এতো আগুন।’ সুমাইয়া বলেন, ‘আসলে ডাইনিং রুমটাই গ্যাসে ভরা ছিল। শার্লিনের রুম ছিল রান্নাঘরের পাশেই। একটা জানালা সম্ভবত বন্ধ ছিল।’ এরপর আরও করুণ ঘটনার বর্ণনা দেন স্বামী ও দুই সন্তান হারানো সুমাইয়া। তিনি বলেন, ‘আমি আর শার্লিনের আব্বু নামছি। আগুন জ্বলতেছে গায়ে। চিৎকার দিয়ে নামতেছি- আগুন লাগছে সাহায্য করেন। বাঁচান... বাঁচান। তিন আর চার নম্বর ফ্লোর থেকে দরজা খুলছে। আমাদের দেখে দরজা বন্ধ করে দিছে। একটা তোষক দিয়ে যদি জড়াইয়া ধরতো। একটা তোষক না হয় পুড়তো। আমার বাচ্চাগুলো তো বাঁচতো। কত মানুষ সব তাকায়া আছে। কেউ আগায় না।’ সুমাইয়া বলতে থাকেন, ‘পরে নিচে নেমে, কাপড় তো পুড়ে গেল। নিচে ছিল ছালার চট। টাইনা গায়ে দিছি। কত মানুষ, সবাই তাকাইয়া আছে, কেউ আগায় না।’ সুমাইয়া বলেন, ‘বলছি আমি মহিলা একটা চাদর দেন। কেউ দেয় না। বিল্ডিংয়ের মহিলারা কেউ দেয় না... আল্লাহ মাফ করুক সবাইকে।’ সুমাইয়া বলেন, ‘পরে নিচে নেমে চিৎকার দিয়ে দারোয়ানকে বললাম আমার দুই ছেলে ওপরে আটকা পড়ছে, আপনারা তাড়াতাড়ি যান। তারা যেতে যেতে শার্লিন পুড়ে গেছে। শার্লিন পুড়েছে বেশি। গায়ে পা থকথক হয়ে গেছে। শার্লিন বলে, আমি তো বাঁচবো না, আমাকে মাফ করে দিয়ো আম্মু। আমি বলি বাবা তুই বাঁচিস, আমি মইরা যাই। মানুষ এ রকম হয়। একটি খারাপ না? কেউ কাউরে একটু সাহায্য করে না। একটা কি কথা?’
এদিকে, সুমাইয়া বেগমের অবস্থা এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। মঙ্গলবার তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউ থেকে মোহাম্মদপুরের বেসরকারি সিটি হাসপাতালের আইসিইউতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এর আগে গত রোববার থেকে ওই হাসপাতালের কেবিনে চিকিৎসাধীন একমাত্র শঙ্কামুক্ত মেজো ছেলে জারিফ বিন নেওয়াজ। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, জারিফ শঙ্কামুক্ত। তার অবস্থা ধীরে ধীরে আরও উন্নতি হচ্ছে। তবে মা সুমাইয়া বেগমের অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.