ভূরাজনীতির কবলে বঙ্গোপসাগর by এ কে এম জাকারিয়া

এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছে সমুদ্র। কৌশলগত গুরুত্বের কারণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মনোযোগের মধ্যে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও উপস্থিতি জরুরি। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে হাজির বাংলাদেশের জন্য দরকারি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে হোক বা নানা সহযোগিতার আবরণেই হোক, সবাই চায় এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান জোরালো করতে। আমরা দেখলাম এ বছরের শুরুর মাসেই দেশে অন্তত তিনটি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হয়ে গেল, যেখানে আলোচনার মূল বিষয় ছিল বঙ্গোপসাগর এবং এ অঞ্চলের সমুদ্র। গত মঙ্গলবার দিল্লিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব জানালেন, আগামী মার্চে সমুদ্র অর্থনীতিতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ ঢাকায় বৈঠকে বসছে।
১৯ শতকের মার্কিন নৌকৌশলবিদ আলফ্রেড থায়ার মাহান সমুদ্রবাণিজ্য, নৌপথ, নৌশক্তি, এর নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ—এসব নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। সেই প্রবন্ধগুলোর সংকলন নিয়ে প্রকাশিত বইটির নাম দ্য ইন্টারেস্ট অব আমেরিকা ইন সি পাওয়ার (১৮৯৭)। সেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সমুদ্রবাণিজ্য বা নৌশক্তি যেভাবেই হোক, সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তার পক্ষে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তার যুক্তি হচ্ছে, স্থলভূমিতে যতই সম্পদ থাকুক না কেন, সমুদ্রপথে সম্পদ বিনিময় বা বাণিজ্য যত সহজ, অন্য কোনো পথে অত সহজ নয়। তিনি লিখেছেন, একটি দেশ যদি দুনিয়ায় বড় শক্তি হতে চায়, তবে তাকে তার আশপাশের জলসীমায় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে। দেশটিকে এমন এক অঞ্চল তৈরি করতে হবে, যাতে অন্যরা তাকে সমঝে চলে এবং বাইরের শক্তিকে তার আশপাশ থেকে দূরে রাখা যায়।
আলফ্রেড মাহানের এই বক্তব্য যে শত বছরেরও বেশি সময় পর সমান সত্য, তা স্বীকার না করে উপায় নেই। আজকের দুনিয়ায় বিশ্ববাণিজ্যের ৯০ ভাগই হয় সমুদ্রপথে। এবং সমুদ্র যোগাযোগব্যবস্থার ওপর কার্যত একক নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সারা দুনিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ছড়ি ঘুরিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু সেখানেই সম্ভবত ভাগ বসানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। এশিয়ার ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক রিচার্ড জাভেদ হেইডেরিয়ান আল-জাজিরায় এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নতুন এক নৌশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সমুদ্রব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে উল্টে দিচ্ছে। চীন তার মহাদেশীয় প্রতিবেশীদের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, তার নৌশক্তিও ক্রমেই বাড়ছে। আবার দেশটির হাতে বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র রয়েছে। এই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে চীন পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জলপথে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতিকে সংকুচিত করতে চাইছে। হলুদ সমুদ্র থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরে চীনা সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী তার আশপাশের সমুদ্রসীমায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ উপস্থিতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।’ (এ সিনো-আমেরিকান নেভাল শোডাউন ইন সাউথ চায়না সি’ ২৯ অক্টোবর ২০১৫)
এটা পরিষ্কার যে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিরোধের আশঙ্কাও। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির আধিপত্য বিস্তার ও বাণিজ্যস্বার্থের এই জটিল হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশের কৌশলী অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই।
ভৌগোলিক কারণে সাগরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এই বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সমুদ্র, সমুদ্রবন্দর বা সমুদ্রবাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে তাই এত নানামুখী তৎপরতা। আলফ্রেড থায়ার মাহান সমুদ্রবাণিজ্য ও সে কারণে এর ওপর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু শত বছরেরও বেশি সময় পর সমুদ্রের গুরুত্ব আরও বেড়েছে এই কারণে যে সমুদ্র এক বড় সম্পদেরও আধার। সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বাইরে সমুদ্রের নিচের তেল ও গ্যাসের মতো মূল্যবান জ্বালানি ও নানা খনিজ সম্পদ এবং ওপরের মাছের ভান্ডার এক দীর্ঘস্থায়ী সম্পদের ক্ষেত্র। ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্রকে ঘিরে অর্থনীতি বর্তমান বিশ্বে এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে।
বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চল ও সমুদ্র সীমানা সংগত কারণেই এখন বৈশ্বিক মনোযোগের মধ্যে রয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম ভাগে বাংলাদেশ সফর করে গেলেন মার্কিন প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার স্কট এইচ সুইফট। বাংলাদেশ নৌবাহিনী আয়োজিত ভারত মহাসাগরীয় নৌ সিম্পোজিয়ামে (আইওএনএস) অংশ নিয়েছেন তিনি। তাঁর এই বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে একটি লেখাও তিনি লিখেছেন। সেখানে এই অঞ্চলের সমুদ্রের গুরুত্ব, নিরাপত্তার বিষয় এবং বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বিএনএস সমুদ্র জয় ও বিএনএস সমুদ্র অভিযান নামে যে দুটি সামরিক নৌযান পরিচালনা করছে, তা একসময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড পরিচালনা করত। মার্কিন নৌবাহিনীর বার্ষিক নৌ অনুশীলন ‘কো-অপারেশন অ্যাফ্লোট রেডিনেস অ্যান্ড ট্রেইনিং’ (ক্যারাট) বাংলাদেশ গত অক্টোবরে চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরে শেষ হয়েছে। ক্যারাট চলাকালে আমাদের দুই নৌবাহিনী জলদস্যুবিরোধী, চোরাচালানবিরোধী, সমুদ্রে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ ও বন্দর নিরাপত্তা বিষয়ে অনুশীলন করে। (প্রথম আলো ১৩ জানুয়ারি, ২০১৬)। তিনি এটাও পরিষ্কার করেছেন যে ‘ইউএস প্যাসিফিক ফ্লিট’ নামের কারণে কেউ যেন এই ভুল না করে যে তারা শুধু মালাক্কা প্রণালির পূর্ব ও সিঙ্গাপুরের ওপর গুরুত্ব দেয়। তারা এই দিকেও নজর রাখে এবং এর ফলে অনেক দেশই উপকৃত হয়েছে।
বৈশ্বিক সামুদ্রিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ ও বার্ষিক প্রায় ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য শুধু দক্ষিণ-চীন সমুদ্র দিয়েই পরিচালিত হয়। প্রায় এক লাখ জাহাজ এই পণ্য সরবরাহ করে ভারত মহাসাগর থেকে আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বাণিজ্য পথ ধরে। এখানে নিজেদের কর্তৃত্ব, খবরদারি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা চীনের নিজস্ব বাণিজ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য খুবই জরুরি। বাংলাদেশ–চীন সম্পর্কের ৪০ বছর উপলক্ষে গত ২৬ জানুয়ারি এক সেমিনার হয়ে গেল। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নিযুক্ত সাবেক পাঁচ চীনা রাষ্ট্রদূত এই সেমিনার উপলক্ষে ঢাকায় জড়ো হয়েছিলেন। চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের ছয় রাষ্ট্রদূতও সেই সেমিনারে হাজির ছিলেন। এই সেমিনারটিকে চীনের তরফ থেকে যে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট। সেই সেমিনারে দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটির বিষয়টি যেমন গুরুত্ব পেয়েছে, তেমনি আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টিও। (প্রথম আলো ২৭ জানুয়ারি)
আমাদের মনে আছে যে ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময় সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সব প্রস্তুতিই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। বিভিন্ন মহলে এই আলোচনা রয়েছে যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শক্তিশালী কোনো কোনো দেশের আপত্তির কারণেই সরকার শেষ সময়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর থেকে সরে আসে। চীনের এ অঞ্চলে প্রবেশ নিয়ে এই দেশগুলোর আপত্তি রয়েছে। কিন্তু বোঝা যায়, বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে চীন এখনো আশা ছাড়েনি এবং বিষয়টি নিয়ে তারা লেগে রয়েছে।
৩১ জানুয়ারি বঙ্গোপসাগরীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বিমসটেক সচিবালয়ের আয়োজনে প্রথম বিমসটেক ফাউন্ডেশন বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বের বঙ্গোপসাগরীয় সংযোগ স্থাপন’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বল স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশেষজ্ঞ কেনেথ আর হল সেখানে মূল বক্তব্য দেন। কেনেথ হল মনে করেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা ও বিরোধের আশঙ্কা দুটোই রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে দক্ষিণ চীন সাগরে বিরোধ দেখা যাচ্ছে। চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়েছে। তবে এরপরও এ অঞ্চলের সম্পদের প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
এটা পরিষ্কার যে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিরোধের আশঙ্কাও। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির আধিপত্য বিস্তার ও বাণিজ্যস্বার্থের এই জটিল হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশের কৌশলী অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। তবে এ ক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ভুল করার সুযোগ যেমন নেই, তেমনি বিলম্ব বা দীর্ঘসূত্রতার সুযোগও কম। বাংলাদেশের জন্য দরকারি গভীর সমুদ্রবন্দর স্পষ্টতই এই ভূরাজনীতির খপ্পরে পড়েছে।
যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে বলতে গেলে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের বিষয়টি চূড়ান্তই হয়ে গিয়েছিল, সেই সোনাদিয়া নিয়ে এখন আর কোনো কথা নেই। এর ২৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে প্রাথমিকভাবে কয়লা আমদানির জন্য একটি গভীর সমুদ্রবন্দর হতে যাচ্ছে জাপানি সাহায্য সংস্থা জাইকার অর্থায়নে। ইঙ্গিত রয়েছে, এটাই পরবর্তী সময়ে সম্প্রসারিত হবে পূর্ণাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দরে। চীনকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবে কি তবে সোনাদিয়া প্রকল্পটি বাদই পড়ছে? চীন তবে কোন সমুদ্রবন্দরের আশায় দিন গুনছে? দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্বের সুফল পেতে হলে বঙ্গোপসাগরেও যে তাদের জোরালো উপস্থিতি লাগবে। চীন কীভাবে তা কার্যকর করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.