সুড়ঙ্গ শেষে আলোর রেখা

বাংলাদেশে শিক্ষার ক্রমাবনতি নাকি ক্রমোন্নতি হচ্ছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, অবনতি হয়েছে। কিন্তু নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিলে বলতেই হবে, অতীতের তুলনায় বর্তমান বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে এই ২০১৫ সালে বাংলাদেশের শিক্ষা অগ্রসর হয়েছে। বলা যাবে না যে অন্ধকার দূর হয়েছে, তবে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তের আলো এখন আগের চেয়ে উজ্জ্বল। এ আলোচনা আমরা মূলত চার ভাগে করার চেষ্টা করব। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংগঠন ইউনেসকোর মতে, যে বিষয়গুলো আলোচনা করলে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বোঝা যায়, সেই তিনটির (শিক্ষার পরিবেশ, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক এবং শিক্ষক) সঙ্গে ‘শিক্ষা প্রশাসন’ জুড়ে দিয়ে ২০১৫ সালের শেষে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কোথায় এসে দাঁড়াল, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করব। প্রথমে শিক্ষা প্রশাসন। সারা দেশে বিনামূল্যে বই বিতরণের বিশাল কর্মযজ্ঞ ছাড়াও এবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তত চারটি উল্লেখযোগ্য অর্জন আছে। এক. শিক্ষাবিদদের পরামর্শে, শিক্ষা বোর্ডগুলো ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ। দুই. আইটি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একাদশ শ্রেণিতে অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু। তিন. শিক্ষক নিয়োগে নতুন নিয়ম প্রবর্তনের উদ্যোগ। চার. চরম রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে এইচএসসি ও এসএসসি পরীক্ষা নেওয়া এবং সঠিক সময়ে ফল প্রকাশ করা।
২০১৪ সালে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীরা এতই বেপরোয়া ছিলেন যে মনে হচ্ছিল তাঁরা অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আমাদের প্রশাসন দেখিয়ে দিয়েছে যে দুষ্কৃতকারীরা যতই শক্তিশালী হোক, কৌশল, দক্ষতা ও ঐকান্তিকতার কাছে তারা হার মানতে বাধ্য। এ বছর এইচএসসি, এসএসসি, জেএসসি ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর কোনো পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তবে মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাটি যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি কলঙ্ক তিলক, তাতে সন্দেহ নেই। ভর্তি-নৈরাজ্য রোধে এবার একাদশ শ্রেণিতে অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। যদিও স্বল্প সময়, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি ও কারিগরি দক্ষতার অভাবে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের অনেকে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন, এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। মানসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা ছিল শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও একচ্ছত্র ক্ষমতা। সম্প্রতি এই ক্ষমতাকে খর্ব করে নিয়োগের একটি নতুন নিয়ম করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদেরা একে স্বাগত জানিয়েছেন। এ বছর শিক্ষা প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পরীক্ষা নেওয়া। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তারা প্রয়োজনে সময়সূচি পরিবর্তন করে, ছুটির দিনে কাজ করে হলেও পরীক্ষা নিয়েছেন এবং সময়মতো ফল প্রকাশ করেছেন। কিন্তু শিক্ষকদের জন্য ২০১৫ সাল খুব ভালো নয়—ভালো-মন্দে মেশানো। ভালো এই অর্থে যে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আর খারাপ এ কারণে যে সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা মনে করছেন অষ্টম পে-স্কেলে তাঁদের মর্যাদাহানি হয়েছে। বর্ধিত বেতনে তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। তাঁরা এখনো আন্দোলনে আছেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন অবসর ও কল্যাণ ভাতা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য। এর বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় আট হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক লাখের মতো শিক্ষক- কর্মচারী এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন। ইউনেসকোর মতে, মানসম্পন্ন শিক্ষার অন্যতম শর্ত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ। লেখাপড়ার জন্য ছেলেমেয়েদের একটি কক্ষে ঢুকিয়ে দিলেই হবে না, কক্ষটিকে হতে হবে সত্যিকারের শ্রেণিকক্ষ।
আগের ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে কক্ষকে শ্রেণিকক্ষে রূপান্তরের প্রক্রিয়া প্রশংসাযোগ্য। যেমন ২০১১ সালে যেখানে বাংলাদেশের কোনো মাধ্যমিক স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ছিল না, সেখানে ২০১৫ সালে ৮০ শতাংশ স্কুল মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করছে এবং সমসংখ্যক স্কুল বিদ্যুতের সংযোগ পেয়েছে। ১০ শতাংশ স্কুল পেয়েছে সৌরবিদ্যুৎ, ৮৫ দশমিক ০৫ শতাংশ স্কুল কম্পিউটার ব্যবহার করার সুবিধা এবং ৩৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ স্কুল ইন্টারনেটের সংযোগ পেয়েছে। ৯১ শতাংশ স্কুলে নিরাপদ পানীয় জলের এবং ৯৯ শতাংশ স্কুলে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা হয়েছে। যদিও শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত এখনো একটু বেশি, তবু শিক্ষার পরিবেশের ক্রমোন্নতি লক্ষণীয়। ২০১৫ সালে আরও কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। যেমন, প্রায় সব স্কুলে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা চালু, প্রায় সব ছেলেমেয়েকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করা (৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ) এবং ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায় সমতা আনা। এখন ছাত্রের তুলনায় ছাত্রীসংখ্যা বরং বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে এখন ছাত্রীর সংখ্যা ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৩ দশমিক ২২ শতাংশ। কয়েক বছর ধরে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তককে বাস্তবসম্মত ও বোধগম্য করার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা করা হয়েছে শিক্ষার্থীকে সাম্য, মৈত্রী, সহনশীলতা, মানবাধিকার, লিঙ্গসমতা, সবুজ অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ, স্বাস্থ্য, নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার। ২০১৫ সালেও এই ধারাতেই ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা নির্ধারণ করে সেই ভিত্তিতে প্রাথমিক স্তরের ২৪টি পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে। আগে শুরু হওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৭৪টি বই ২০১৫ সালে শেষ হয়েছে। শুধু নতুন বই নয়, ইংরেজি ভার্সনের পুরোনো বইগুলোও এখন পরিমার্জিত হচ্ছে। এ ছাড়া যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির জন্য তৈরি হচ্ছে ১৬টি ইন্টারেকটিভ ডিজিটাল টেক্সট। ২০১৫ সালে প্রকাশিত অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণাপত্রে বাংলাদেশে উচ্চ ও প্রাথমিক শিক্ষার শুধু প্রসার নয়, মানেরও ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। একটি ইউনেসকো, অপরটি গণসাক্ষরতা অভিযান। ইউনেসকোর বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ এশিয়ার খুব সফল দেশগুলোর একটি। মানও উন্নত হয়েছে। অপ্রতুল বরাদ্দ সত্ত্বেও আগের চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, তাদের প্রয়োগও বাড়ছে—বিশেষ করে কৃষিতে। কৃষিতে ২০০ ফলিত গবেষণায় অর্থায়ন করা হচ্ছে, বৃত্তি পাচ্ছেন ১০৮ জন নারী ও পুরুষ বিজ্ঞানী। কৃষি গবেষণার সুফল এখন বেশ দৃশ্যমান। গণসাক্ষরতা অভিযান তার গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০১৯ সালের মধ্যে সব শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। গণিত, বিজ্ঞান, ইংরেজি,
বাংলা, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়—এই প্রত্যেকটি বিষয়ে ছাত্রছাত্রীরা আগের চেয়ে ভালো করেছে। তবে গবেষণাপত্রটির পরামর্শ হচ্ছে, ৫০ শতাংশ শিক্ষক বাড়িয়ে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত আরও কমিয়ে ১: ৩০-এ নামিয়ে আনা এবং এখনো যে ৩০ লাখ শিশু স্কুলের বাইরে রয়ে গেছে, তাদের দ্রুত স্কুলে নিয়ে আসা। সন্দেহ নেই, উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর বেশির ভাগই আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে দিকনির্দেশ করে। এ জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মিলেছে। জাতিসংঘ এমডিজি লক্ষ্যপূরণে সফল হওয়ার জন্য আমাদের প্রশংসা করেছে, শিক্ষামন্ত্রী পেয়েছেন ইউনেসকোর সহসভাপতির পদ। কিন্তু সুড়ঙ্গ শেষের আলো উজ্জ্বলতর হওয়ায় নিকষ অন্ধকার ফিকে হয়ে এলেও আঁধার এখনো আছে। যেমন, ২০১৫ সালে সরকার প্রচুর শিক্ষক-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও চমৎকার সৃজনশীল পদ্ধতির ক্লাস নেওয়া বা প্রশ্ন করার মতো পর্যাপ্ত শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষামন্ত্রী কঠোর হলেও অনিয়ম দূর হয়নি। যাই হোক, এখন যেভাবে চলছে, তাতে অনেক বিষয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি এবং এগিয়ে যাব। কিন্তু কিছু বিষয় আছে, যেমন ‘মানসম্পন্ন শিক্ষক’, যা বর্তমান ধারায় এগোলে আমরা কখনোই পাব না। আমরা তো জানি ‘মানসম্পন্ন শিক্ষক’ না থাকলে ‘মানসম্পন্ন শিক্ষা’ আশা করা বৃথা। আর এর জন্য চাই আরও বেশি বিনিয়োগ, যেমনটি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টোটা। অর্থনৈতিক অগ্রগতির তুলনায় শিক্ষা-বিনিয়োগ ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল বাজেটের ১৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সেখান থেকে পরের বছর কমে হলো ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ, তারপর ক্রমান্বয়ে ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ, ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ, ১১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং সর্বশেষ এ বছর তা কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৭ শতাংশে। আমাদের মতো দেশে শিক্ষা-বিনিয়োগ যে সবচেয়ে লাভজনক, সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা তা নিশ্চয়ই জানেন। সচেতন নাগরিক মাত্রই আশা করেন ২০১৬ সালের বাজেটে শিক্ষা আশানুরূপ বরাদ্দ পাবে। ‘শিক্ষা পরিবারের’ সদস্যরা তার যথাযথ ব্যবহার করবেন এবং এমন একদিন আসবে, যখন আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে সরাসরি সূর্যালোকে উদ্ভাসিত হব, সুড়ঙ্গ শেষের আলোর জন্য আর হাপিত্যেশ করতে হবে না।
গোলাম ফারুক: ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।
faruk.golam@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.