বাঙালির আত্মপরিচয়!

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা জুলিয়াস সিজারের একটি উক্তি ইতিহাসখ্যাত, ‘আমি এলাম, আমি দেখলাম, আমি জয় করলাম’ (Veni, Vidi, Vici); তিনি কথাটা বলেছিলেন এশিয়ায় একটি যুদ্ধজয়ের পর। আর ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার জুলিয়াস সিজার শীর্ষক বিয়োগান্ত নাটকে একটি কালোত্তীর্ণ উক্তি বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে —ব্রুটাস, তুমিও! (Thou too, Brutus)। জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণী উপেক্ষা করে সিজার খ্রিষ্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ যখন সিনেট অধিবেশনে উপস্থিত হলেন, তখন সিনেটররা একে একে তাঁকে ছুরিকাঘাত করতে লাগলেন; সবশেষে তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধু ব্রুটাসকে ছুরিকাহস্তে এগিয়ে আসতে দেখে জুলিয়াস আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘ব্রুটাস, তুমিও!’ সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়ছিলাম। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান আর একটা হলো আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, পরশ্রীকাতরতা। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে পরশ্রীকাতর বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সব ভাষাতেই পাবেন, সব জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সব রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।’ এই কথাগুলো পড়তে গিয়েই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার নাটকে সিজারের শেষ বচনটি এবং বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ‘বঙ্গবন্ধু, আপনিও!’ পরক্ষণেই ভাবলাম, বঙ্গবন্ধু তো যথার্থই বলেছেন, আর তা ছাড়া স্বাধীনতাসংগ্রামকালে নয় মাস পর পাকিস্তানের জেল থেকে বেরিয়ে এসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু এটাও তো বলেছেন, ‘কবিগুরু, আপনি মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছেন।’
অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছিলেন, কবিগুরু যে লিখেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি’, এটা সত্যি নয়; তা নইলে বাঙালি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারত না। তবে হ্যাঁ, ‘নদী-শিকস্ত ও নদী-পয়স্ত’ অঞ্চলের অধিবাসী বলেই বোধ করি বাঙালি চরিত্রে যুগপৎ এই বৈপরীত্য প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে কবিগুরু অন্যত্র বলেছেন, ‘আমরা (বাঙালিরা) আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না; ...পরের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিকস এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’ কিন্তু এ কথাটা তিনি বলেছেন কোথায় দাঁড়িয়ে? দাঁড়িয়ে নয়, বসে লিখেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রশ্বস্তি গাইতে গিয়ে; আর বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বাঙালিই। অধুনা নীরদ চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙালি শীর্ষক বইটিও পুনর্বার পড়ছিলাম। বইটির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালির বাঙালি বলিয়া যত দিনের ইতিহাস আছে তাহার সবটুকু জুড়িয়া ভালো বাঙালি শুধু আপনভোলা বাঙালির মধ্যেই দেখা দিয়াছে। বাকি যাহারা ধন, মান, ঐহিক ক্ষমতা বা প্রতিষ্ঠা চাহিয়াছে, তাহাদের বাসনা যখন শক্তির অল্পতা বা সমাজের ভয়ের দ্বারা সংযত থাকে নাই তখন তাহারা নামে চোর-ডাকাত না হইলেও চরিত্র ধর্মে তাহাই হইয়াছে।’ অবশ্য বাঙালিদের সম্পর্কে সবচেয়ে অপবাদসূচক কথাটি বলেছেন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রশাসনের ইস্পাত-কাঠামোর স্থপতি লর্ড মেকলে, ‘বাঘের কাছে থাবা যা, মৌমাছির কাছে হুল যা, মহিষের কাছে শিং যা, মহিলাদের কাছে সৌন্দর্য যা, একজন বাঙালির কাছে প্রতারণাও তা।’ তাহলে কি বাঙালির কোনো গুণ নেই? ঈশ্বরগুপ্তর ভাষায়, ‘কোন গুণ নাই তার, কপালে আগুন?’ আছে, আছে; অবশ্যই আছে। এটা বিজয়ের মাস, বিজয়ের মাসে অবশ্যই বলতে হয়, মাত্র নয় মাস স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে (প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতায়) দখলদার বাহিনী থেকে দেশকে মুক্ত করতে কেবল বাঙালিই পারে। আর সামনে আসছে ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলনের মাস; মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কেবল বাঙালিরাই পারে। তা ছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত, রবীন্দ্রনাথ,
নজরুল ও জীবনানন্দ দাশের মতো কবি, নেতাজি, শেরেবাংলা ও বঙ্গবন্ধুর মতো দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন ও আর পি সাহার মতো দানবীর—এঁরা এবং আরও অনেক বাঙালিকে নিয়ে আমরা গর্ব করে থাকি। বাঙালির রসবোধও অত্যন্ত প্রখর। পাশ্চাত্যে ওরা হাসে ভরাপেটে, যে কারণে ওদের ‘আফটার-ডিনার স্পিচ’গুলো থাকে হাস্যরসে ভরপুর। বাঙালি হাসে খালি পেটেও, যে কারণে বলা হয় যে বাঙালি মরলেও নাকি তার দাঁত বের করা হাসি ফুরোয় না। সর্বোপরি বাঙালি অন্যের লেগ-পুলিংয়ে ওস্তাদ—সে ঢাকার আদিবাসীদের বলে ‘কুট্টি’, বিহারের লোকদের বলে ‘খোট্টা’, পশ্চিমবঙ্গের লোকদের বলে ‘ঘটি’, আসামের লোকদের ‘আসামি’ আর একপর্যায়ে গান্ধীজিকে পছন্দ করত না বলে নাকি একটি পোকার নাম দিয়েছে ‘গান্ধী পোকা’। চাকরির ইন্টারভিউকালে ‘আপনি কাঁপছেন কেন’ প্রশ্নের উত্তরে সে যে বলেছে ‘এইডা কী কাঁপন দেখছেন, স্যার, প্রশ্ন শুরু করেন, তারপর আসল কাঁপন দেখতে পাবেন’—এই গল্প পুরোনো ও বহুলকথিত। এ স্থলে হাল আমলের একটি উপাখ্যান উপস্থাপন করা যাক: এক বাঙালি গিয়েছে বাজারে তরকারি কিনতে। সে দেখে যে তরকারিওয়ালা সমানে তরকারিতে পানি ছিটাচ্ছে। পানি ছিটানোর উদ্দেশ্য কিন্তু শুধু তরকারিকে সতেজ দেখানোই নয়, ওজনেও ভারী করা। তো একপর্যায়ে তরকারিওয়ালা ‘ভাইজানের কী চাই’ বলতেই সে উত্তর দিল, ‘আপনার পটোলের হুঁশ ফিরলে পর আমাকে এক কেজি দিয়েন।’ বলা বাহুল্য, কেউ বেহুঁশ হয়ে গেলে হুঁশ ফেরানোর জন্য সাধারণত পানির ঝাপটা দেওয়া হয়ে থাকে। পরিশেষে বলি, আপন মাংস যেমন হরিণের বৈরী, তেমনি বাঙালিই বাঙালির প্রতিদ্বন্দ্বী। সে সাবানের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে ‘বাংলা সাবান’, মদের মধ্যে যেটি নিকৃষ্টতম সেটির নাম দিয়েছে ‘বাংলা মদ’, অতএব দুর্মুখেরা বলাবলি করবেই, ‘এই নিরিখে জাতির মধ্যে সবচেয়ে মন্দ যে জাতি, সেটা হচ্ছে বাঙালি জাতি।’ দুর্মুখদের এটা বলার সুযোগ করে দেওয়া সঠিক হয়নি। যাহোক, জয় হোক বাঙালি জাতির সর্বত্র।
আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷

No comments

Powered by Blogger.