বনশ্রীতে ১০ শিশু উদ্ধার নানা রহস্য

১০ থেকে ১৩ বছরের মধ্যে তাদের বয়স। সংখ্যায় ওরা ১০ জন। সবাই গরিব পরিবারের সন্তান। এদের কেউ কেউ ছেলেবেলায় হারিয়েছে বাবা অথবা মাকে। কারও বাবা-মা’র ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার কারণে ছিল এতিমখানায়। কেউ বা নিখোঁজ হয়েছিল স্কুল বা মাদরাসা থেকে। এরপর কোন হদিস ছিল না তার। এমন ১০ শিশুকে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীতে একটি কথিত এনজিওর কার্যালয় থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। উদ্ধারকৃত শিশুরা হলো- আব্বাস উদ্দীন (১০), আকাশ (১০), ফরহাদ (১০), ইব্রাহিম মণ্ডল (৯), বাবলু (১০), স্বপন হোসেন (১১), রফিক হোসেন (৯), মোবারক হোসেন (১০), আবদুল্লাহ আল মামুন (১৪) ও কাওসার হোসেন (১৪)। পুলিশের ধারণা, ওই শিশুগুলোকে পাচারের জন্য ওই বাড়িতে রাখা হয়েছিল। তবে অদম্য বাংলাদেশ নামে কথিত ওই এনজিও কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে শিশুদের পুর্নবাসনের উদ্দেশ্যে তাদের সেন্টারে রাখা হয়েছিল। এ ঘটনায় এক মহিলাসহ চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলো: আরিফুর রহমান, জাকিরা সুলতানা, ফিরোজ আলম ও হাসিবুল হাসান। আরিফুর রহমান নিজেকে ‘অদম্য বাংলাদেশ’-এর চেয়ারম্যান ও জাকিরা সুলতানা নিজেকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এসময় ওই বাসা থেকে ৪টি কম্পিউটার, বিভিন্ন নথিপত্র ও ১০টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জানান, শনিবার দুপুর ১২টায় বনশ্রীর সি ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ৭ নম্বর বাড়ির ছয়তলায় ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিও থেকে অভিযান চালিয়ে ১০ শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ওই সময় ওই শিশুদের সেখানে রক্ষণাবেক্ষণকারী এক মহিলাসহ চারজনকে আটক করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, উদ্ধারকৃত এক শিশুর অভিভাবকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে অভিযান চালানো হয়েছে। যাদেরকে সেখান থেকে আটক করা হয়েছে তারা ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে একটি এনজিওর কর্মকর্তা ও কর্মচারী বলে দাবি করেছে। ওই বাসাটিতে তারা শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ করতো। তিনি আরও জানান, তারা কিছু কাগজপত্র পুলিশের কাছে জমা দিয়েছে। সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। উদ্ধারকৃত কয়েক শিশু পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছে যে, তাদের সেখানে ঠোঙ্গা বানাতে দেয়া হতো। ওই শিশুদের কি উদ্দেশ্যে সেখানে রাখা হয়েছিল এবং তাদের ভবিষ্যতে কি করা হতো তা জানার জন্য আটককৃতদের প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, তদন্তে যদি এনজিও কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাধ কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে উদ্ধারকৃত শিশু মোবারকের চাচা মনির হোসেন বাদী হয়ে শিশু পাচারের অভিযোগে থানায় একটি মামলা করেছেন। আটককৃতদের আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। গতকাল বিকালে কথিত ওই এনজিওর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়ারা তাদের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ওই ভবনের ছয়তলায় শিশুদের রাখা হতো। তবে ওই ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে কোন সাইনবোর্ড দেখতে পাওয়া যায়নি সেখানে। ফ্ল্যাটের ভেতরের পরিবেশ খুবই নোংরা।  ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে কর্মকর্তারা বসেন। একটি খাবারের কক্ষ। অপর আরেকটি কক্ষে ১০ শিশুকে রাখা হতো। পুলিশ ওই বাসাটি সিলগালা করে দিয়েছে। বাড়ির কেয়ারটেকার আনিসুর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি। এমনকি প্রতিবেশীরাও এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। উদ্ধারকৃত শিশু মোবারক হোসেনের চাচা মাংস ব্যবসায়ী মনির হোসেন জানান, তিনি পরিবারের সঙ্গে সবুজবাগের বাসাবোতে থাকেন। তার বড় ভাইয়ের ছেলে মোবারক খিলগাঁওয়ের উত্তর গোড়ানের বোরহান ঈদগাঁও মাদরাসায় হেফজ বিভাগের ছাত্র ছিল। ছোটবেলায় তার বাবা মারা গেছে।  প্রায় ১ মাস আগে তাকে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস থানার মওটুপি এলাকা থেকে ওই মাদরাসায় ভর্তি করি। তিনি আরও জানান, গত শুক্রবার সন্ধ্যার সময় ওই মাদরাসায় গেলে সেখানকার কয়েকজন ছাত্র জানায় যে, প্রায় এক সপ্তাহ আগে একটি এনজিও তাকে পড়ালেখা করানোর জন্য নিয়ে গেছে। পরে ওই এনজিওয়ের ঠিকানা নিয়ে সেখানে যাই। ওই এনজিওর কার্যালয়ে গেলে তার ভাতিজা কান্নাকাটি করে। বলে, তাকে মারধর করা হয়। জোর করে ঠোঙ্গা বানাতে দেয়। নিয়মিত খাবার দেয়া হয় না। তিনি আরও জানান, ভাতিজার এমন কথা শুনে আমি ওই এনজিওয়ের এক কর্মকর্তাকে বলি যে, আমার ভাতিজা এখানে থাকতে চায় না। তাকে আমি নিয়ে যাবো। তখন ওই কর্মকর্তা আমাকে হুমকি-ধমকি দেয়। সেখান থেকে চলে যেতে বলে। আমি আসার সময় আমার ভাতিজা কান্নাকাটি শুরু করে। পরে আমি পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ সেখান থেকে তার ভাতিজাসহ ১০ জনকে উদ্ধার করে। মনির হোসেন অভিযোগ করেন, ওই ভুয়া এনজিওর অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। বিষয়টি পুলিশকে তিনি খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেন। উদ্ধার হওয়া শিশু রফিক জানান, তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার গৌরিপুরে। ছোটতে বাবা মারা গেছে। এখানে তাকে কে নিয়ে এসেছে প্রশ্ন করলে ‘জানি না’ বলে উত্তর দেয়। আরেক শিশু ফরহাদ জানান, তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের মোল্লা পাড়ায়। মা ছোটবেলায় মারা গেছে। কার সঙ্গে ওই বাসাটিতে সে এসেছে প্রশ্ন করলে এক মহিলা তাকে ওই বাড়িতে দিয়ে গেছে। আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, তার বাড়ি নরসিংদী এলাকায়। এলাকার এক বড় ভাই এখানে রেখে গেছে। ওই বাড়িতে শুধু কম্পিউটারে গেমস খেলতো বলে জানায় সে। বাড়ির বাইরে যেতে দেয়া হতো না। মাঝেমধ্যে খাবার দেয়া হতো না। একটি বাসে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। ১ মাস আগে একবার চিড়িয়াখানায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে আমি কৌশলে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। পরে আমাকে মারধর করা হয়। রামপুরা থানার ওসি মাহাবুবুর রহমান জানান, এনজিওর পক্ষ থেকে কিছু কাগজপত্র দেয়া হয়েছে। এসব কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.