‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না’ -জাতিসংঘের বিশেষ দূত

বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের মত প্রকাশের স্থান সংকুচিত হয়ে আসা এবং নিবর্তনমূলক আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকা সফররত জাতিসংঘের বিশেষ দূত হেইনার বিলেনফেন্ড। উদ্বেগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে বাংলাদেশ  কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এখানে ১০ দিন ধরে আছি। অনেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার মনে হয়, এখন এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে নাগরিক সমাজের কর্মকাণ্ডে আইনি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, অনলাইন কর্মী এবং অন্যদের মুক্ত ও ভয়হীন মত প্রকাশের অধিকার ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না। জাতিসংঘের ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিষয়ক স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়্যার হেইনার বিলেনফেন্ড গত ৩১শে আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। গতকাল ছিল তার সমাপনী সংবাদ সম্মেলন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লউঞ্জে তিনি তার সফরের বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স উপস্থিত ছিলেন। জাতিসংঘ দূত বলেন, বাংলাদেশ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম এবং বিশ্বাসের লেকজনের একসঙ্গে বসবাস এবং সমাজিক যোগাযোগের বিষয়টি বংশপরম্পরায় চলে আসছে। এটি ঐতিহাসিকই বলা যায়। এদেশের সংবিধানেও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি রয়েছে। আমি মনে করি এর চর্চা সর্বক্ষেত্রে সমান হওয়া দরকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা সরজমিন ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেন তিনি। জানান, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। ঢাকায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিভিন্ন ধর্ম, বিশ্বাস এবং কূটনৈতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। জাতিসংঘের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা হয়েছে তার। আগামী বছরের শুরুতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশে তার সফর নিয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রসঙ্গে হেইনার বিলেনফেন্ড বলেন, মানবাধিকার সংস্থার কর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনা বাংলাদেশে অনেকদিন ধরেই চলছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়, ‘আদিবাসী’ জনগণ ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলাপচারিতায়, আমি এক ধরনের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি আরও ভাল করে জেনেছি। এ নিরাপত্তাহীনতার ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক, আইনি ও সামাজিক মাত্রা রয়েছে, যা বিভিন্নভাবে ব্যক্তিবিশেষ ও গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে পারে। তার ভাষায়, ‘সমপত্তি দাবি, বিশেষ করে ভূমি সম্বন্ধীয় ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় কাজ করে। এখানে নিজ বা নিজ সমপ্রদায়ের শারীরিক নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা ও ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় চরমপন্থার বিষয় রয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যায় সংখ্যালঘু সমপ্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সমপ্রদায়ের হার হ্রাসের বিষয়ে তিনি বলেন, আরও অনেক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে যাতে করে তারা আরও নিরাপত্তা বোধ করতে পারে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ, যা বর্তমানে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মনে হচ্ছে একে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ওতপ্রোতভাবে একে-অপরের সঙ্গে জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইন্টারনেট অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের সুরক্ষা দিতে হবে। নিয়ন্ত্রণমূলক আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা যা বর্তমানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিরোধীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে তা যদি ধর্ম নিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্যও গ্রহণ করা হয় তবুও অসাবধানতাবসত হলেও তা মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যখন চরমপন্থি ও ধর্মীয় অবস্থান সমাজে প্রকাশিত হতে থাকে তখন পুরো পরিবেশ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তবে তার পর্যবেক্ষণ- কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা কেবল সংখ্যালঘুদের অধিকার তা নয়। বরং এটি সকল মানুষের অধিকার। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতিকে ধারণ করা বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামও রয়েছে। এর ফলে একটি অসপষ্টতা তৈরি হয় যা সরাসরি দেশের মানবাধিকারের ওপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায়ও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা একটি প্রতিশ্রুতির প্রতিনিধিত্ব করে। একে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছে ধর্মীয় বৈচিত্র্যতাকে উন্মুক্ত ও মুক্ত পরিবেশ প্রদানের জন্য। যা হবে ভয় ও বৈষম্য থেকে মুক্ত। ধর্ম নিরপেক্ষতার এমন সুষ্ঠু বোঝাপড়ার জন্য শিক্ষা, নাগরিক সমাজ, উন্নয়ন ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন পদক্ষেপ ও বিনিয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। জাতিসংঘের এ বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ার ধর্মীয় ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা উন্নয়নে সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে ভয়ে থাকা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য। জাতিসংঘের এ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ নিজ পর্যবেক্ষণে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতি নিয়ে আপস করার এক ধরনের উদ্বেগজনক চর্চা তৈরি হয়েছে, যা আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় জঙ্গিদের রাগান্বিত না করতেই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুরক্ষা করতে নেয়া কিছু পদক্ষেপ বরং উল্টো ফলাফল বয়ে আনবে বলে দেখা যাচ্ছে। একই সঙ্গে এসব গণতন্ত্রের মতো ধর্মনিরপেক্ষতার অনেক মূল নীতির পরিবেশকেই সংকুচিত করে ফেলবে। তিনি বলেন, উদাহরণস্বরূপ, সামপ্রতিক ব্লগার হত্যাকাণ্ডে সরকারি কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি বিবৃতি ছিল অসপষ্ট। সহিংস কর্মকাণ্ড ও হুমকির নিন্দা জানানোর পাশাপাশি, সরকারি প্রতিনিধিরা ধর্মের সমালোচনাকারী ব্যক্তিদেরও তিরস্কার করেছেন। তাদেরকে ‘বেশি বাড়াবাড়ি’ না করতেও বলেছেন। সরকারের নিজেদেরই উচিত রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা। সংবিধানে উল্লেখ থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকারের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিদ্যমান আচরণ ও চর্চাকে সমন্বয় করার আহ্বান জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.