রোহিঙ্গা সমস্যা ও আমরা by সৈয়দা রোযানা রশীদ

বাংলাদেশ শরণার্থীর উৎস দেশ না হয়েও আঞ্চলিকভাবে উদ্ভূত শরণার্থী সমস্যার মোকাবিলা করে আসছে চার দশকেরও অধিক সময় ধরে। প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে উৎখাত হওয়া রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বাংলাদেশের আশ্রয় প্রার্থনা আরম্ভ হয় সত্তরের দশকের শেষ ভাগে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নির্যাতনে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু এ সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নব্বইয়ের দশকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশ এবং বাংলাদেশের আশ্রয়দানের ঘটনা সবার জানা। বাংলাদেশ সরকার সে সময় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ জরুরি সহায়তার ব্যবস্থা করে বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়। উল্লেখ্য, ২ লাখ ৫০ হাজারের মধ্যে ২ লাখ ৩২ হাজার রোহিঙ্গা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মধ্যস্থতায় মিয়ানমারে ফিরে যায়।
নব্বইয়ের দশকে প্রবেশ করাদের প্রায় ১০ শতাংশের অনির্দিষ্টকালের জন্য শরণার্থীশিবিরে অবস্থান এবং পরবর্তী সময়ে নাফ নদী পেরিয়ে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের টেকনাফ, উখিয়া, কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে বসতি স্থাপন ক্রমাগতই ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন ও সরকারকে। তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গাবিরোধী জনমত। অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে, স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজার নষ্ট করা, বাংলাদেশি পরিচয়পত্র নিয়ে ভোটে অংশগ্রহণ, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম অভিবাসন, অপরাধমূলক কাজ যেমন, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক ও মানব পাচার এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচার ও অভিবাসনের ঘটনায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি আবারও আলোচনায় আসে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে রোহিঙ্গাদের কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশে আশ্রয় মিলবে না।
ওপরের তথ্যগুলো মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো কতগুলো তাত্ত্বিক ও নীতিনির্ধারণী বিষয় বিশ্লেষণ করা, যা সার্বিকভাবে বিশ্ব শরণার্থী সমস্যা এবং বিশেষভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে রাষ্ট্রগুলোর দ্বৈত অবস্থানকে নির্দেশ করে। বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে নীতিনির্ধারণী মহলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হলো ‘অবৈধ অর্থনৈতিক অভিবাসী’ হিসেবে তাদের অনুপ্রবেশ। এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নয়, গৃহযুদ্ধ, জাতিরাষ্ট্রগত দাঙ্গা, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি কারণেই নব্বইয়ের দশকের পর মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুপাতে। জাতিসংঘের হিসাবে বর্তমান বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা পাঁচ কোটিরও অধিক, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকেই অন্য দেশে প্রবেশের জন্য তাই বেছে নিচ্ছে ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের ব্যবহৃত পন্থা ও পথ।
কয়েক মাস ধরে বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে ভাসমান অবস্থায় অথবা মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের জঙ্গলে মৃত ও জীবিত অবস্থায় প্রাপ্ত কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা জনগণ উদ্ধার হওয়ার ঘটনা অথবা ভূমধ্যসাগরের ভাসমান জাহাজে ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ঠেলাঠেলির নীতি প্রকারান্তরে এ সত্যটিই তুলে ধরে। ফলে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে অনিয়মিত পন্থায় যাত্রাকারী ‘শ্রম অভিবাসী’ এবং যুদ্ধবিগ্রহ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা রাষ্ট্রের শোষণনীতির শিকার ‘শরণার্থী’র মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য অনেক হলেও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে এ ব্যবধান যেন ক্রমে কমিয়ে আনা হচ্ছে। অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের নামে জোরদার হচ্ছে শরণার্থীর প্রবেশ ঠেকানো।
শরণার্থী সৃষ্টি হওয়া, তাদের আশ্রয় এবং ফেরত পাঠানোর পুরো বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্ক থাকে। রোহিঙ্গাদের উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায় যে রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় এই ক্ষুদ্রতর জাতিগোষ্ঠীটি বৃহত্তর শাসকগোষ্ঠীর দমন ও বহিষ্কারের রাজনীতির শিকার। অন্যদিকে, আশ্রয়দাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশও পৃথিবীর উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ যেমন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার মতোই শরণার্থী বা ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’দের আশ্রয় বা প্রবেশাধিকার দেওয়ার আগে অভ্যন্তরীণ সংহতি ও অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টি নিয়ে অনেক বেশি শঙ্কিত। জনগণের সরকারকে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হয়, কেননা রাজনৈতিক দলের জনপ্রিয়তা বাড়া-কমার পেছনে সে দলের শরণার্থী বা অভিবাসন নীতির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব থাকে। রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশে শরণার্থীদের মানবাধিকার বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা কমাতে তাই সবার আগে বিষয়টি বিরাজনীতিকরণ করা প্রয়োজন।
শরণার্থী মোকাবিলায় শরণার্থী-বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনেরও যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় শরণার্থী মোকাবিলা ও পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে গৃহীত জাতিসংঘের এ সনদ ১৯৬৭ সালে সব দেশের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শরণার্থী তৈরির ইতিহাস থাকলেও দক্ষিণ এশীয় কোনো দেশ এই সনদ অনুসমর্থন করেনি। শরণার্থী মোকাবিলার বিষয়টি চলছে রাষ্ট্রের খেয়ালখুশির ভিত্তিতে। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশন, যার মূল কাজ শরণার্থী-বিষয়ক আইনের প্রয়োগ ও শরণার্থীর মানবাধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ফলে তাকেও পরিণত হতে হয়েছে ত্রাণ সরবরাহকারী সংস্থায়। উন্নত বিশ্বের অনাগ্রহ এবং শরণার্থী ও অভিবাসীবিরোধী মনোভাব এই সংস্থাকে বাধ্য করেছে অনুন্নত এবং অক্ষম দেশগুলোকে ত্রাণ বা সাহায্যের বিনিময়ে উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে। অনেক সময় যে সেটাও সম্ভব হয় না, তার প্রমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, যাদের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো ফলপ্রসূ সমাধান অর্জন সম্ভব হয়নি। শরণার্থী সমস্যার সহজ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য তৈরি এ আইনের স্বীকৃতি ও প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।
পরিশেষে, বাংলাদেশের শরণার্থী সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও বিশ্বায়নের এ যুগে একে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। প্রতিবেশী হিসেবে এবং আঞ্চলিক আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। তাই, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের স্বার্থ জড়িত। দৃঢ়ভিত্তিক নির্যাতনের ভয়ে আশ্রয়প্রার্থী ব্যক্তিদের চিন্তিত করা ও আশ্রয়দানের মধ্য দিয়ে ‘শরণার্থী’ ও ‘অর্থনৈতিক অভিবাসী’-সংক্রান্ত দ্বিধা দূর করে বিষয়টিকে বিরাজনীতিকরণ করা এবং শরণার্থী নীতির সপক্ষে জনমত গড়ে তোলা সম্ভব। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এই দলিল অনুসমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল মানবাধিকার সুরক্ষায় দৃষ্টান্ত স্থাপনই নয়, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্বিবেচনায় মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আঞ্চলিক সংস্থা ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায় করতে পারবে।
সৈয়দা রোযানা রশীদ: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.