মানব পাচার বেড়েছে ৬১% by ফারুক ওয়াসিফ ও সুজয় মহাজন

থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় শংখলা প্রদেশের একটি রাবার বাগানে
পাচারকারীদের এক গোপন ঘাঁটি। সেখানে পড়ে রয়েছে তাঁবু,
হাঁড়ি-পাতিল ও জ্বালানি কাঠ। গতকাল সন্ধান পাওয়া এই ঘাঁটিসহ
এ পর্যন্ত দেশটির গভীর জঙ্গলে ছয়টি ঘাঁটির অস্তিত্ব মিলেছে
সমুদ্রপথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত হয়ে এক বছরের ব্যবধানে মানব পাচার বেড়েছে ৬১ শতাংশ। প্রধানত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে পাচার হওয়া এসব মানুষের মধ্যে বাংলাদেশিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গাও রয়েছে।
গত বছর জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বঙ্গোপসাগর দিয়ে অবৈধভাবে গেছেন ৫৩ হাজার লোক। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৩ হাজার। অক্টোবর থেকে জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে বেশি পাচারের ঘটনা দেখা গেছে।
অভিবাসন ও মানব পাচারবিষয়ক দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটিং মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট বা রামরুর মতে, এক বছরের ব্যবধানে মানব পাচার বৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান খুবই উদ্বেগজনক। পাচার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ সংখ্যা বেড়েছে।
রামরু বলছে, স্থানীয় দালালেরা বেশির ভাগ লোককে ভালো চাকরি ও ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করে। পরে গভীর সমুদ্রে যাওয়ার পর এসব লোককে জিম্মি করে তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হয় ২ লাখ ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত।
রামরুর হিসাবে, ২০১৪ সালে পাচারের সময় বাংলাদেশিদের মধ্যে ৫৪০ জন গভীর সমুদ্রে মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। তাঁদের মধ্যে কেবল সিরাজগঞ্জ জেলার বাসিন্দা প্রায় ৫০০। একই জেলার ২৫০ জনের সন্ধান মিলেছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন কারাগারে। তিন হাজার ৫০০ পরিবারের অধিকাংশ থেকেই মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করেছে পাচারকারীরা।
রামরু ও ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের করা যৌথ সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ১ কোটি ৬০ লাখ থেকে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষের স্থায়ী নিবাস থেকে স্থানান্তরিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকেই টার্গেট করা হচ্ছে পাচারের জন্য।
রামরুর পরিচালক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ভোলা, সিরাজগঞ্জ, বরিশাল, রংপুর ও কুড়িগ্রামের মতো ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার এলাকার লোক, যাঁরা অন্য জেলায় স্থানান্তরের কথাও চিন্তা করতেন না, তাঁরাই এখন সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের সামনে উন্নতির আর কোনো পথ নেই।
সরকারি উদ্যোগে জনশক্তি রপ্তানির ব্যর্থতা?: রামরু বলছে, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানির জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া সরকারের (জিটুজি) মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হওয়ার পর থেকে অবৈধ পথে মানব পাচারের ঘটনা বেড়েছে।
এর আগে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ ছিল। বন্ধ বাজারের দ্বার খুলতে এবং মালয়েশিয়ায় কম খরচে ভোগান্তি ছাড়া কর্মী পাঠানোর উদ্দেশ্যে দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি হয়।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাব অনুযায়ী, চুক্তি স্বাক্ষরের পর সরকারের আহ্বানে ১৪ লাখ লোক নিজেদের নাম নিবন্ধন করেন। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত গেছেন প্রায় সাত হাজার। অথচ চুক্তির পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বছরে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি কর্মীকে বৈধ পথে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে।
এই চুক্তির সমালোচনা করে তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, এক অর্থে জিটুজি চুক্তিরই ব্যর্থতার পরিণতি অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচার। এই চুক্তিটি ব্যর্থ হওয়ায় অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, তাঁরা ভ্রমণ বা বেড়ানোর নামে ভিসা নিয়ে বিমানে ওই দেশে গিয়ে থেকে যাচ্ছেন। আবার যাঁদের সামর্থ্য নেই, তাঁরা দালালদের প্রলোভনে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
২০১২ সালে রামরুর পক্ষ থেকে বার্ষিক অভিবাসন প্রবণতাবিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারকে সতর্ক করা হয় যে মানব পাচার বৈধ অভিবাসনের পথে অন্তরায় হয়ে আসবে।
বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আলী হায়দার চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ উপায়ে মানব পাচার বাড়ায় যাঁরা বৈধ অভিবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাঁদেরও ভাবমূর্তির সংকটে পড়তে হচ্ছে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হযরত আলী প্রথম আলোকে বলেন, মালয়েশিয়ায় কম খরচে জনশক্তি রপ্তানির জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের সরকারের মধ্যে এ-বিষয়ক চুক্তিও রয়েছে। এখন সরকারি এই উদ্যোগকে সফল করতে দরকার সবার সহযোগিতা।
চুক্তির পর অবৈধ পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা বাড়ার বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, ‘খরচ কমানোর জন্যই কর্মীদের স্বার্থে এ চুক্তি। সরকারের এমন উদ্যোগের পরও কেউ যেন কারও প্রলোভনে অবৈধ পথে জীবনের ঝুঁকি না নেন সেটিই আমাদের প্রত্যাশা।’

No comments

Powered by Blogger.