ঋণ বাতিলে হিলারিকে প্রভাবিত করার প্রশ্নই আসে না -ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি

কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে, ন্যাশনাল ইকোনমিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৫ই মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন বলে বলা হয়েছে। মন্তব্যগুলো অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক হওয়ায় তথাকথিত ওইসব মন্তব্যে আমরা হতবিহ্বল। আমাদের প্রত্যাশা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে ওইসব মন্তব্য আদৌ করেননি। কিন্তু ওই মন্তব্যগুলো ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আরোপ করা প্রতিটি উদ্ধৃতির আমরা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি অনুযায়ী): আমার ও আমার সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে ড. ইউনূস বিশ্বব্যাংক থেকে পদ্মা সেতুর তহবিল বাতিলের জন্য হিলারি ক্লিনটনকে প্রভাবিত করেছেন। তিনি দেশের জন্য ক্ষতিকর।
আমাদের প্রতিক্রিয়া: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম যখন এ অভিযোগ করেছিলেন, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তখন বিবৃতিতে বলেছিলেন, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্ন। আর তিনি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কখনই বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না। কাজেই প্রফেসর ইউনূসস পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিলে হিলারি ক্লিনটনের প্রভাব ব্যবহার করতে তাকে বলেছেন সেটার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এমন একটি কাজ তিনি কখনই করবেন না। এটা মর্মাহত করার মতো যে, এমন একটি বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে কোন প্রকার তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন না করেই প্রধানমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন বলে তার উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগনের জন্য কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টিতে প্রফেসর ইউনূস তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার কাজ ও অবদান বিশ্বজুড়ে নোবেল শান্তিপুরস্কার এবং অন্যান্য নানা পুরস্কারের মধ্য দিয়ে স্বীকৃত হয়েছে। তিনি সবসময় বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সফলতার প্রচার করেছেন। এবং তিনি বাংলাদেশেকে উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে উপস্থাপন করতে সহায়তা করেছেন। তাকে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর বলাটা খুবই দুঃখজনক। গণমাধ্যমে যেসব বক্তব্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলো এসেছে গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক ফাউন্ডেশনের ওপর ইম্প্লিমেন্টেশন মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশনের (আইএমইডি) প্রেজেন্টেশন চলাকালীন। সেখানে উপসংহার টানা হয়েছে যে, প্রতিষ্ঠানটির পদ্ধতি দরিদ্রদের সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের প্রতিক্রিয়া: গ্রামীণ ফিশারিজ কার্যক্রম নিয়ে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে টানা উপসংহার সম্পূর্ণ ভিত্তিহীণ। গ্রামীণ ফিশারিজ গড়ে তোলার জন্য ১৯৮৬ সালে ২৫ বছর মেয়াদে সরকারের কাছ থেকে পুকুর লিজ নেয়। ২০১০ সালে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সরকারের কাছে প্রকল্পটি হস্তান্তর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকালীন, গ্রামীণ ফিশারিজ পরিত্যক্ত পুকুরগুলোকে ফিশারিজে পরিণত করেছে। মাছ চাষ হওয়া পুকুরের সংখ্যা ৩৩৯ থেকে ৬১৫তে উন্নীত করেছে। মাছ উৎপাদন ৪৬ টন থেকে ২০ হাজার ৪শ’ টনে বৃদ্ধি করেছে। সরকারের কাছে হস্তান্তরের সময় মাছ বিক্রি করে আয়ের পরিমাণ ১২.৮৭ লাখ থেকে ৭০ কোটিরও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। প্রকল্পটি সফলভাবে পরিচালিত এবং অত্যন্ত সফল ছিল; লিজ চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় ২০১১ সালে সরকারের কাছে পুকুরগুলো ফিরিয়ে দেয়ার পর যার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি অনুযায়ী): গ্রামীণফোন, গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীনফোনের যৌথপ্রকল্প হওয়ার কথা ছিল। ড. ইউনূস গ্রামীণফোনের শেয়ার বিক্রি করেছেন।
আমাদের প্রতিক্রিয়া: মূলত গ্রামীণফোন একটি যৌথ প্রকল্পের প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণফোনের একটি মালিক হলো নরওয়ে সরকারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান টেলিনর। গ্রামীণফোনের দ্বিতীয় মালিক হলো গ্রামীণ টেলিকম যা কোম্পানি আইনের ২৮ ধারার অধীনে নিবন্ধিত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যার কোন বেসরকারি মালিক নেই। গ্রামীণফোনের বাকি মালিকরা হলেন, বাংলাদেশের অসংখ্য বিনিয়োগকারী/শেয়ারহোল্ডার যারা অব্যাহতভাবে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার পুঁজিবাজারে কেনাবেচা করেন। প্রফেসর ইউনূস অতীতেও গ্রামীণফোনের কোন শেয়ারের মালিক ছিলেন না, না এখন তার কোন শেয়ার আছে। কাজেই তার শেয়ার বিক্রির প্রসঙ্গই ওঠে না। কোন সময়ই গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণফোনের কোন শেয়ারের মালিক ছিল না। কাজেই গ্রামীণ ব্যাংকের জিপি’র শেয়ার বিক্রি করার প্রশ্ন ওঠে না। গ্রামীণফোনের সকল অংশীদারের সম্মতি সাপেক্ষে সাধারণ জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রি ব্যতীত গ্রামীণ টেলিকম তাদের কোন শেয়ার বিক্রি করেনি। গ্রামীণ টেলিকম দরিদ্র নারীদের উদ্যোক্তা সুযোগ দেয়ার জন্য গ্রামে ফোন সেবা দেয়ার ভিলেজ পে ফোন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে।  এ কার্যক্রমে হাজারও নারী সম্পৃক্ত। তারা এ থেকে ভাল উপার্জন করে থাকেন। গ্রামীণফোনের পথপ্রদর্শনকারী কাজের কারণেই টেলিফোন সেবা আজ এতোটা সুলভ। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও এখন মোবাইল ফোন অধিকাংশ মানুষের নাগালের মধ্যে। গ্রামীণফোনের যে মুনাফা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমে যায় তা দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণার্থে গৃহীত প্রকল্পগুলোর সহায়তায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (সংবাদ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি অনুযায়ী): দরিদ্র মানুষেরা ক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতির ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। এতে চড়া হারে সুদ দিতে হয়। প্রধানত এর লক্ষ্য হলো বাণিজ্যিক। গ্রামীণ ব্যাংকের ৫৪টি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং যেসব প্রতিষ্ঠানে গ্রামীণ নামটি রয়েছে তা তুলে ধরে কিভাবে দরিদ্ররা ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে।
আমাদের প্রতিক্রিয়া: গ্রামীণ ব্যাংক আর এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কার্যক্রমগুলো সারা বাংলাদেশ জুড়ে সক্রিয়। এ মডেল সারা বিশ্বে অনুকরণ করা হয়েছে। আর অনেক ইমপ্যাক্ট স্টাডিতে দেখা গেছে যে, প্রচলিত ব্যাংকগুলো যেখানে দরিদ্রদের আর্থিক সহায়তা দেয় না, সেখানে কোন প্রকার জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার মাধ্যমে জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে দরিদ্রদের সুযোগ তৈরি করে দেয়া ক্ষুদ্রঋণ। বাংলাদেশে সক্রিয় সকল রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের তুলনায়  গ্রামীন ব্যাংকের সুদের হার সব থেকে কম। গ্রামীণ ব্যাংকে ‘ক্ষুদ্রঋণ ফাঁদ’ নেই। দেশব্যাপী এর ঋণগ্রহীতারা তাদের প্রাপ্ত সেবার অত্যন্ত কদর করে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের বিরাট একটি অংশের (৭৫ শতাংশ) মালিক ঋণগ্রহীতারা। বোর্ডের বেশির ভাগ সদস্য তারা। ব্যাংকের মালিকদের ক্ষতি করার কোন সুযোগ ব্যাংকের নেই।
গ্রামীণ ব্যাংক শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করেছে। শুধু গত ১২ মাসে (এপ্রিল ২০১৪ থেকে মার্চ ২০১৫) গ্রামীণ ব্যাংক ঋণ হিসেবে দিয়েছে ১৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকে সকল ঋণগ্রহীতার মোট সঞ্চয় ছিল ১০ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। একই তারিখ পর্যন্ত দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৯০২৫ কোটি টাকা। বাংকে ঋণগ্রহীতাদের জমা অর্থের পরিমাণ ব্যাংকের কাছে তাদের ঋণের তুলনায় বেশি। খুব বেশি ব্যাংক এমন রেকর্ডের দাবি করতে পারবে না।
একটি প্রধান দৈনিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি অনুযায়ী, তিনি তার পরিচিত এক নারীর উদাহরণ দিয়েছেন যিনি ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন কিন্তু তাকে ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছিল। গ্রামীণ ব্যাংকে এটা সম্ভব নয় কেননা জিবির নিয়মে কোন অবস্থাতেই মোট সুদের পরিমাণ দেয়া হয়। পেনশন তহবিল, শিশুদের জন্য শিক্ষাঋণ এবং দুর্যোগকালীন সাহায্য সহ বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক। এছাড়া শেয়ারহোল্ডার হিসেবে তারা ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর ব্যাংকের মুনাফা থেকে লভ্যাংশ পাচ্ছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন সেগুলো স্বতন্ত্র অর্থায়নে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংকের কাছ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে কোন বিনিয়োগ নেই। কাজেই তাদেরকে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান বলা যায় না। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালায় না। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে কিভাবে দরিদ্র মানুষ ‘আটকে যাচ্ছে’ তা বোঝা যাবে সেটা স্পষ্ট নয়।
এটা মর্মাহত হবার মতো বিষয় যে, প্রফেসর ইউনূসের মতো একজন সম্মানীয় ব্যক্তি সম্পর্কে কোন প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়া এমন গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন বলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। বিশেষভাবে ব্যক্তিগতভাবে প্রফেসর ইউনূসের জন্য। এগুলো দেশের ভেতরে ও বাইরের মানুষের মনের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করে। আমরা এর আগেও এসব অভিযোগ ও ইস্যুর বিস্তারিতভাবে জবাব দিয়েছি। গণমাধ্যম আমাদের সকল প্রতিক্রিয়া বিস্তারিত প্রকাশ করেছে। এটা দুঃখজনক যে আমাদের প্রতিক্রিয়ার কোন উল্লেখ না একই অভিযোগ বার বার সামনে আসে। সার্বিক রেকর্ড স্পষ্ট ও খোলাসা করার জন্য আমরা আবারও প্রকৃত ও সত্য তথ্যগুলো তুলে ধরলাম।
৭ই মে ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো বিবৃতি

No comments

Powered by Blogger.