বিএসএফের গুলিতে হতাহত, গ্রামে গ্রামে চাপা কান্না

বিএসএফের গুলিতে নিহত কিশোর শাহ আলমের ছবি মুঠোফোনে
দেখছেন পরিবারের দুই সদস্য। বিষণ্ন চিত্তে শাহ আলমের ব্যবহৃত
বইপুস্তকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তার মা সেলেনা খাতুন
(সর্ব ডানে)। সম্প্রতি তোলা ছবি l সাজিদ হোসেন
মাটির তৈরি ঘর। ভেতরে চৌকির ওপর রাখা কয়েকটি বই-খাতা। পাশে আলনায় যত্নে রাখা জামা-কাপড়। সেগুলোর দিকে তাকাতেই চোখ ভিজে যায় বাড়ির বাসিন্দাদের। এ ঘরে চেরাগ জ্বালিয়ে যে ছেলেটি উচ্চ স্বরে পড়া আয়ত্ত করত, তাকে আর কোনো দিন দেখা যাবে না। ঘরজুড়ে কেবলই শূন্যতা।
যে নদীতে মিলেমিশে আছে তার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি—সে নদীর পাড়েই চিরনিদ্রায় শায়িত সে। তার নাম শাহ আলম। পড়ত অষ্টম শ্রেণিতে। বাড়িতে সবাই ডাকতেন আলম আর সহপাঠীরা ডাকত সাজু বলে। স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষে মা-বাবার পাশে দাঁড়ানোর। পড়াশোনার ফাঁকে তাঁদের কাজে হাতও বাড়িয়ে দিত সে। অভাবের সংসার। সামান্য উপার্জনের আশায় রাখালের (ভারতীয় গরু-মহিষ পারাপার) কাজ করতে গত বছরের ১৯ নভেম্বর সীমান্তের ওপারে গিয়েছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলি তার বুক ভেদ করে বেরিয়ে যায়। নিথর পড়ে থাকে তার দেহ।
ঠাকুরগাঁওয়ের সীমান্তবর্তী গ্রামের প্রায় বাড়িতেই শাহ আলমের মতো এমন রাখালের খোঁজ মেলে। বিএসএফর নজরে পড়লেই হতভাগ্য এ মানুষগুলোর ভাগ্যে জোটে গুলি, নতুবা নির্যাতন শেষে কারাভোগ।
সরেজমিনে জানা গেছে, বালিয়াডাঙ্গীর বৈউরঝারি, মণ্ডুমালা, রত্নাই, নাগরভিটা, রানীশংকৈলের ধর্মগড়, জগদল ও হরিপুরের মলানী, ডাবরী, বুজরুক, পীরগঞ্জের চান্দেরহাট, বৈরচুনা সীমান্তের গ্রামগুলোর অনেক কিশোর-তরুণ গরু-মহিষ পারাপারে সম্পৃক্ত। এসব গ্রামে ঘরে ঘরেই রয়েছে আহত-নিহত হওয়া লোকজনের কাহিনি।
গত জানুয়ারিতে পীরগঞ্জের চান্দেরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আবদুর রহমান। ২০১৩ সালের শুরুতেই হরিপুরের বুজরুক সীমান্তে নিহত হন নুর ইসলাম ও একই উপজেলার মুক্তার দাই। অক্টোবরে নাগরভিটা সীমান্তে নিহত হন কালিয়া মাহমুদ। ২০১২ সালের জুনে বালিয়াডাঙ্গীর বেউরঝারি সীমান্তে চড়ুইগেদি গ্রামের মো. ফারুক, সেপ্টেম্বরে নাগরভিটা সীমান্তে দক্ষিণ দোয়ারি গ্রামের আজিরুল হক, অক্টোবরে মণ্ডুমালা সীমান্তে আবুল খালেক, পীরগঞ্জের বৈরচুনা সীমান্তে দস্তমপুর গ্রামের গণেশ নিহত হন।
গত দুই বছরে সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের গুলিতে আহত হন বালিয়াডাঙ্গীর চেড়ইগেদি গ্রামের মো. রমিজ, মো. সাদেকুল, মো. বাবুল ও হাবিল উদ্দিন, বালিয়াডাঙ্গীর কাশিডাঙ্গা গ্রামের মাহমুদ, ফিরোজ মাহমুদ ও মরাধার গ্রামের তরিকুল ইসলাম, মণ্ডুমালা গ্রামের কামাল হোসেন, জিয়াবাড়ি মোড়ল হাট গ্রামের দাইমুল হক, পশিরুল ইসলাম, রত্নাই গ্রামের ইদ্রিস, চৈত্যু, রানীশংকৈলের ভদ্রশ্বরী গ্রামের মো. খোকনসহ আরও ১৫ জন।
শুটকাবস্তির কাউসার আলী ২০১১ সালে ওপারে গরু আনতে গিয়ে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন। নির্যাতনের পর বিএসএফ তাঁকে পুলিশে দেয়। ১৪ মাস কারাভোগের পর গত বছরে ফিরে আসেন কাউসার। জানতে চাইলে কাউসার বলেন, ‘কাজকাম পাইলে কেউ যায় নাকি? না পাইলে আবার যেতে পারি। মানুষের কাছে চেয়ে খাওয়ার চেয়ে ওটাই ভালো।’
শুটকাবস্তি গ্রামের শের আলীর একমাত্র ছেলে ছিল শাহ আলম। সম্প্রতি তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলল মা ও দুই বোনের। মা সেলেনা খাতুন বলেন, ‘বাবার অসুখ দেখিয়া ছুয়াটা (ছেলে) ভারতে যাবারতানে জেদ ধরে। মুই কহিনু ওইঠে গেলে গুলি হইবে। হামার কথা না শুনিয়া একদিন গরু আনিবা চলে গেইল। হামার ফুটফুটে ছুয়াটা মরে গেইল।’ শাহ আলমের কথা বলতে বলতে বাড়ির সবার মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ আইয়ুব আলী বলেন, ‘এই কাজটা অবশ্যই বেআইনি। কিন্তু আমার মনে হয়, সারা বছর যদি তাদের কাজ থাকত, রোজগারের কোনো রাস্তা থাকত, তাহলে তারা এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেত না।’
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৩০ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল তুষার বিন ইউনুস বলেন, দরিদ্র মানুষ টাকার লোভে ওপারে যায়। অনেক সময় হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তাই এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে সীমান্তে অপরাধ ও সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বিজিবি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বেউরঝারি সীমান্তের শুটকাবস্তিতে ‘আলোকিত সীমান্ত’ নামে একটি পরীক্ষামূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এটি সফল হলে তা পর্যায়ক্রমে দেশের সব সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.