প্রতিবাদ দমনে লাঠিপেটা

বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনাকারীদের কাউকেই ২৬ দিনেও চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো যাঁরা নিপীড়কদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি করছেন, গতকাল রোববার পুলিশ তাঁদের ওপরই বর্বর হামলা চালিয়েছে। নারী লাঞ্ছনার বিচার চাইতে এসে উল্টো লাঞ্ছিত হয়েছেন ছাত্রীরাও। পুরুষ পুলিশের লাথি-ঘুষি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েকজন ছাত্রীকে। ধাওয়া খেয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছাত্রীটিকেও চুলের মুঠি ধরে টেনে বের করে পিটিয়েছে পুলিশ।
পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেতে গাছের আড়ালে লুকিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের এই নেত্রী। কিন্তু পুলিশের এক সদস্য সেখান থেকে তাঁকে চুল ধরে টেনে আনেন। পেছন থেকে লাথি মারেন আরেক পুলিশ সদস্য। গলাধাক্কা দেন অপর পুলিশ সদস্য। গতকাল দুপুরে রাজধানীর শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি থেকে ছবিগুলো তুলেছেন সাজিদ হোসেন
নিপীড়কদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিসহ ছয় দফা দাবিতে গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয় ঘেরাও করতে গিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের ডিএমপি কার্যালয়ের সীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি পুলিশ। মেরে-ধরে রাস্তা থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে ৩৪ জন আহত হয়েছেন বলে ছাত্র ইউনিয়ন জানিয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২১ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চারজন ভর্তি আছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। এ ঘটনায় ছাত্র ইউনিয়নের পাঁচ নেতা-কর্মীকে আটকের পর পুলিশ রাতে ছেড়ে দেয়।
নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের দমনে পুলিশ এত মারমুখী হলো কেন—জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি ডিসি রমনার (রমনা বিভাগের উপকমিশনার) সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আবদুল বাতেন ঘটনাস্থলেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘দাবি পেশ করার জন্য লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি করে রাস্তা আটকে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে পারেন না। হাজার হাজার গাড়িঘোড়া বন্ধ করে রাখতে পারেন না। আপনারা দেখেছেন, তাঁরা প্রায় আধঘণ্টা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলেন। ওনাদের বারবার রিকোয়েস্ট করেছি। তখন তো রাস্তা পরিষ্কার করা আমাদের দায়িত্ব।’
পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে একদল যুবক দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের লাঞ্ছিত করে। তাদের বাধা দিতে গিয়ে আহত হন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীসহ দুজন। শুরু থেকেই লিটন নন্দী ও অন্যরা অভিযোগ করে আসছিলেন, বারবার পুলিশের সাহায্য চাওয়া হলেও পুলিশ লাঞ্ছনাকারীদের ঠেকাতে বা ধরতে এগিয়ে আসেনি। দুজনকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করা হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।
পুলিশের হাত থেকে রেহাই পেতে গাছের আড়ালে লুকিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের এই নেত্রী। কিন্তু পুলিশের এক সদস্য সেখান থেকে তাঁকে চুল ধরে টেনে আনেন। পেছন থেকে লাথি মারেন আরেক পুলিশ সদস্য। গলাধাক্কা দেন অপর পুলিশ সদস্য। গতকাল দুপুরে রাজধানীর শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি থেকে ছবিগুলো তুলেছেন সাজিদ হোসেন
পরে বিষয়টি গণমাধ্যমে এলে পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথমে বিষয়টিকে নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশেরই সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজে লাঞ্ছনার প্রমাণ মেলে। তবে এ ঘটনার ২৬ দিনেও সেই লাঞ্ছনাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।
লাঞ্ছনার ঘটনার পরদিন থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রসংগঠন দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে। ঘটনার পরদিন থেকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিদিন কোনো না কোনো সংগঠন কর্মসূচি পালন করছে।
এর পরও পুলিশ দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় ৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে সংবাদ সম্মেলন করে ‘পাল্টা আঘাত’-এর ব্যানারে ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্র ইউনিয়ন। সেই কর্মসূচিতে আরও কয়েকটি ছাত্র ও নারী সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে তারা। মিছিলে দুই শতাধিক ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য সংগঠনের কর্মীরা অংশ নেন। মিছিলটি কলাভবন, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ, মধুর ক্যানটিন ঘুরে শাহবাগ হয়ে ডিএমপি কার্যালয়ের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাধা পেয়ে শাহবাগ থানার সামনে থেকে ঘুরে মিছিলটি কার্জন হলের দিকে যাত্রা করে। টিএসসি পেরিয়ে দোয়েল চত্বরে আসতেই আবারও পুলিশি ব্যারিকেড। শিক্ষার্থীদের মিছিলটি কাঁটাতারের বেড়া সরিয়ে হাইকোর্টের দিকে এগোতে থাকে। সেখানে আগে থেকেই ঢাল, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও শিক্ষার্থীদের মিছিলটিকে কোনো বাধা দেয়নি পুলিশ। এরপর হাইকোর্টের সামনে আরও একটি পুলিশের বাধা পার হয় মিছিলটি। কাকরাইল মসজিদের পাশ দিয়ে শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণিতে (সার্কিট হাউস রোড) যাওয়ার পর আবারও পুলিশের বাধা। এবার বাধা ভাঙতে না পেরে রাস্তার ওপর বসেই স্লোগান দেওয়া শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২০ মিনিট রাস্তায় বসে পুলিশের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও স্লোগান দেন নেতা-কর্মীরা। বক্তব্যের একপর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাসান তারেক বলেন, ‘এখানে যতসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে তারা থাকলে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটত না।’ তারেকের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর স্লোগান দেওয়ার একপর্যায়ে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের মাইকের ব্যাটারির সংযোগ ছিনিয়ে নেয়। বিক্ষোভকারীরা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলে পুলিশ মারতে শুরু করে। পুলিশের লাঠি, বন্দুকের বাঁট আর বুট চলে সমানতালে। নেতা-কর্মীরা কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়ে মার খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান। হাসান তারেকসহ কয়েকজন মার খেয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকেন কিছুক্ষণ। পরে অন্যরা তাঁদের তুলে নিয়ে যান। কিছু দূরে গিয়ে আবারও তাঁরা সংগঠিত হয়ে পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস, জলকামান থেকে পানি ছুড়ে পাল্টা জবাব দেয়। ধাওয়া খেয়ে বিভিন্ন ভবন, দোকানের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া বিক্ষোভকারীদেরও খুঁজে বের করে মারধর করে পুলিশ।
এ সময় সার্কিট হাউস রোডে সরকারি কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারের সামনে ফুটপাতে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছাত্র ইউনিয়নের নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সদস্য ইসমত জাহানকে চুলের মুঠি ধরে বের করে আনেন পুলিশের একজন পুরুষ সদস্য। সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন ছুটে যান তাঁকে মারতে। একজন লাথি মারেন, আরেকজন ওড়না ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, আরেকজন গলাধাক্কা দেন। এ সময় ইসমত পড়ে যান। এরপর পুলিশ তাঁকে টেনে তোলার জন্য টানাহেঁচড়া করে। সেখানে পুলিশের নারী সদস্য থাকলেও তাঁরা নীরব ছিলেন।
বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে গতকাল ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও করতে যান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। এ সময় শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণিতে তাঁদের লাঠিপেটা ও মারধর করে পুলিশ l ছবি: প্রথম আলো
পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য দাবি করেন, বিক্ষোভকারীদের ইটপাটকেলের আঘাতে তাঁরা আহত হয়েছেন। কয়েকজন গায়ের উর্দি খুলে আঘাতের চিহ্ন দেখান গণমাধ্যমকর্মীদের।
রাতে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটকের পর রাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সরকারি কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলে সন্ধ্যায় ওসি জানিয়েছিলেন। অবশ্য রাত ১২টা পর্যন্ত মামলা হয়নি।
যাঁদের আটক করা হয়েছিল, তাঁরা হলেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক রায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত ও কর্মী সাদ্দাম হোসেন, তেজগাঁও শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক অন্তু চন্দ্রনাথ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কর্মী আরিফুল ইসলাম।
পুলিশি হামলার প্রতিবাদে আজ সারা দেশে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং কাল মঙ্গলবার সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে ছাত্র ইউনিয়ন।

No comments

Powered by Blogger.