মানবপাচার রোধে বেড়েছে ‘হঠাৎ তৎপরতা’

থাইল্যান্ডের বিভিন্ন জঙ্গলে গত কয়েক দিনে বাংলাদেশিদের গণকবর উদ্ধারের খবরে হঠাৎ বেড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা। গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে চারজন সন্দেহভাজন মানব পাচারকারী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। আটক করা হয়েছে ২৩ জনকে।
তবে এমন ‘হঠাৎ উদ্যোগ’ না নিয়ে পাচার রোধে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনার পক্ষে মত দিয়েছেন একজন বিশেষজ্ঞ।
মানব পাচার নিয়ে কাজ করে এমন বিভিন্ন সংগঠন ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা যায়, সাধারণত স্বল্প খরচে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে দালালেরা দরিদ্র লোকজনকে টেকনাফ ও উখিয়ায় এনে জড়ো করে। পরে টেকনাফ থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে তাদের উঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে গিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকতে পারে। তবে তাদের বিরাট একটা অংশকে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে রেখে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কাছে মুক্তিপণের জন্য অর্থ দাবি করা হয়। আবার অনেক সময় সাগরপথে যাওয়ার সময় নৌকা বা ট্রলার ডুবে বহু মানুষ মারা যায়। সেসব ঘটনায় মামলাও হয়। কিন্তু এ সমস্যার সুরাহা হয় না।
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইট এক সংবাদে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের বরাত দিয়ে বলেছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ২৫ হাজার বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা পাচারের ঘটনা ঘটেছে। যা গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। তবে ওই সংবাদে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি করেন, দেশ থেকে মানব পাচারের হার কমেছে।
শরণার্থী নিয়ে কাজ করে রামরু নামের একটি সংগঠন। রামরুর নির্বাহী কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোজানা রশিদ বলেন, সরকার বিভিন্ন সময়ে মানবপাচারের বিষয়টিকে লুকানোর চেষ্টা করেছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পর এটি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশে মানবপাচারকারীদের শক্ত নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে এবং এখান থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়। পরে তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়, হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে।
এভাবে ব্যাপক হারে লোক পাচার হলেও মানবপাচার প্রতিরোধে পুলিশের তৎ পরতা চোখে পড়ার মতো নয়। তবে সম্প্রতি থাইল্যান্ডে গণকববের সন্ধান এবং বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের উদ্ধারের পর পুলিশে তৎপরতা বেড়েছে।
গত শুক্রবার টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান তিন সন্দেহভাজন মানবপাচারকারী ধলু হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম জাফর আলম পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এদের তিনজনের বিরুদ্ধে মানব পাচারের ১৯টি মামলা রয়েছে। গতকাল শুক্রবার টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে জাফর মাঝি নামে এক মানবপাচারকারী মারা যান। তাঁর বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় মানব পাচারের অভিযোগে পাঁচটি মামলা ছিল।
এ ছাড়া গত এক সপ্তাহে ২৩ জন সন্দেহভাজন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আজ সোমবার ভোররাতে টেকনাফ থেকে মো. খায়ের হোসেন, মো. আলী হোসেন ও আবদুর রহমান নামে তিন সন্দেহভাজন মানবপাচারকারীকে আটক করেছে পুলিশ। এ নিয়ে গত দশদিনে শুধুমাত্র টেকনাফ জেলা থেকেই ১৩ জন মানবপাচারকারীকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজার থেকে আটক করা হয়েছে সাতজনকে, মহেশখালী থেকে দুজন এবং উখিয়া থেকে আটক করা হয় একজনকে।
সহযোগী অধ্যাপক রোজানা রশিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ঘটার পর সরকারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। সরকার এখন ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে বলার চেষ্টা করছে যে মানবপাচার প্রতিরোধে তারা তৎপর। এটি ‘আইওয়াশ’। যাদের আটক করা হচ্ছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বিচারের ব্যবস্থা করলে মূল হোতারা আটক হতো। সরকার এখন যেভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে কোনো কাজ হবে না।
গত শুক্রবার বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া ধলু হোসেন অন্তত পাঁচ হাজার মানুষকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর চেষ্টা করেছেন বলে জানান কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নয়টি মামলাও হয়। কিন্তু এত দিন বহাল তবিয়তেই ছিলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.