ওদের সামনে শুধুই অন্ধকার by শিপন হাবীব

এলএলবি উত্তীর্ণ রাবিনা করিম টুম্পা। স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রখ্যাত আইনজীবী হবেন। আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়বেন। হাসি ফোটাবেন বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনদের মুখে। কিন্তু পেট্রলবোমার আগুন তাকে ‘উপহার’ দিয়েছে জীবনের সবচেয়ে বড় দীর্ঘশ্বাস। টুম্পা এখন ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিট আইসিইউতে চরম শংকটাপন্ন অবস্থায় ভর্তি রয়েছেন। তিনি অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয় আইনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। রোববার রাতে টুম্পা ও তার খালাতো বোন কুনতলাসহ ৪ জন রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় বাসে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হন। কুনতলা রাজধানীর টিএন্ডটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজম্যান্টের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। টুম্পা ও কুনতলার দু’হাত, পুরো মুখমণ্ডল, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। দু’জনের চোখ পুড়ে, ফুলে গেছে। খোলা সম্ভব হচ্ছে না। টুম্পা, কুনতলার মতো ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি ৫২ জনের কেউই আশংকামুক্ত নয়। এদের মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি ৫ জন চরম শংকটাপন্ন। ইতিমধ্যে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
টুম্পা ও কুনতলা খালোতো বোন হলেও দু’জনের সম্পর্ক বান্ধবীর মতো। রোববার বনশ্রীতে বড় বোন মোহসীনা শিকদার নিপার বাসা থেকে বাসযোগে বাড্ডায় আসছিল তারা। তখন রাত সোয়া ৯টা। বনশ্রী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছাড়ার ২-৩ মিনিট পরেই বাসটিতে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তে পুড়ে যায় পুরো বাসটি। আহত হয় তারা দু’বোনসহ মোট ৬ জন। যাদের মধ্যে টুম্পা, কুনতলাসহ ৪ জনকে ঢামেক হাসপাতাল বার্ন ইউনিটে ওই রাতেই ভর্তি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা বলছেন, টুম্পা ও কুনতলার পোড়া ক্ষতের সঙ্গে চোখেও মারাত্মক আঘাত রয়েছে। দু’জনেরই চোখের উপর পুরোটা পুড়ে গেছে। থেতলে গেছে চোখের উপরের অংশ। ফুলা থাকায় দু’জনেই চোখ খুলতে পারছে না। দু’জনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। মেয়ে টুম্পার ক্ষত-বিক্ষত পোড়াদেহের সামনে দাঁড়িয়েই বাবা রেজাউল করিম লিটন কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, ওতো আমার মেয়ে না, ওতো আমার মা। জীবনে কোনো দিন, কখনও, রাজনীতি করেনি। পড়াশোনায় মগ্ন থাকত। এলএলবি পাস করল। অনেক স্বপ্ন আছে আমার মায়ের (টুম্পার)। তাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হল কেন? টুম্পার মা জিনাত রেহেনার কান্নাও থামানো যাচ্ছিল না। তিনি শুধুই বলে যাচ্ছিলেন আমার মেয়েকে যেন সুস্থ করে তোলা হয়।
কুনতলার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে দুঃখিনী মা নাজমা শিকদার। মাথার পাশে মেয়েকে টানা ডাকছেন, উত্তর দিচ্ছে না মেয়ে। নাজমা শিকদার জানালেন, আর কত মানুষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারা হবে। কুনতলার বাবা আবদুল হালিম শিকদার বেশ কয়েক বছর আগে মারা যান। অনেক কষ্ট করে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছিলেন।
বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন বিভাগের প্রধান প্রফেসর ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার জানান, রোববার রাতে ভর্তি দু’বোন টুম্পা ও কুনতলার অবস্থা আশংকাজনক। টুম্পার অবস্থা চরম শংকটাপন্ন। তিনি বলেন, তাদের দু’জনেরই চোখে মারাত্মক আগুনের ক্ষত রয়েছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে, তারা এটি দেখছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দু’জনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। টুম্পাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে। কুনতলার অবস্থা অবনতি হলে তাকেও আইসিইউতে নেয়া হবে।
৫ জানুয়ারি থেকে পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে মোট ২১ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। যাদের মধ্যে টুম্পা, কুনতলাসহ ৬ জন এখনও ভর্তি রয়েছেন। বাকিরা চলে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.