র‌্যাবের দাবি খুনি ডিবি বলছে অন্য কথা by নুরুজ্জামান লাবু

রাজধানীর মগবাজারে আলোচিত তিন খুনের ঘটনায় পৃথক অভিযানে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। র‌্যাবের দাবি- এরা প্রত্যেকেই মগবাজারের তিন খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবির তদন্তে এদের মধ্যে অন্তত ছয় জনের বিরুদ্ধে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার সম্পৃক্ততা মিলছে না। এমনকি এ ছয় জনের মধ্যে একজন ক্যানসার রোগী। এছাড়া ছাত্র, ডিশ ব্যবাসায়ী ও নির্বাচন কমিশনের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীও রয়েছে এদের মধ্যে। একই নামে রয়েছে দু’জন। যাদের কাউকে কাউকে অন্তত মাস খানেক আগে ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয়ে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। র‌্যাব-পুলিশে খোঁজ করে না পেয়ে স্বজনরা থানায় জিডি ও অপহরণ মামলা করেছেন। দীর্ঘদিন পর র‌্যাব তাদের ‘একদিন আগে’ গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে। পরে তাদের তিন খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। আসামি গ্রহণ করলেও সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি এ ছয় জনকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়নি। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, তদন্ত তার নিজস্ব গতিতে চলছে। তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তাদেরই কেবল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে। সূত্র জানায়, মগবাজারের তিন খুনের ঘটনায় ডিবি এখন পর্যন্ত ৯ জনকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে। এর মধ্যে সোহেল, ফারুক, আরিফ ও জনিকে ঘটনার পরপরই ডিবি গ্রেপ্তার করে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ভোরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় তিন খুনের প্রধান অভিযুক্ত শাহ আলম ওরফে কাইল্যা বাবু। এ সময় তার দুই সহযোগী আল আমীন ও রাজিবকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২০শে সেপ্টেম্বর র‌্যাব ছয় জনকে গ্রেপ্তারের পর ডিবির কাছে হস্তান্তর করে। তারা হলো সিয়াম, রমজান, মারুফ, রুবেল, শাফিন ও আল আমীন। এদের মধ্যে সিয়াম ও মারুফ এজাহারভুক্ত আসামি। রমজান ও রুবেল কাইল্যা বাবুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। এ কারণে এ চার জনকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। বাকি দু’জন আল আমীন ও শাফিনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অস্ত্র মামলায় চালান দেয়া হয়। সর্বশেষ গত শনিবার আরও পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তারা হলো সোহেল, কামাল, রাহাজুল, বিল্লাল ও অপু। র‌্যাবের দাবি, এই পাঁচজনও মগবাজারের তিন খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। শনিবার র‌্যাব ৩-এর সিপিসি-২ মগবাজার ক্যাম্পের ডিএডি শ্যামল কান্তি বিশ্বাস রমনা থানায় তাদের হস্তান্তর করে। কিন্তু ডিবি পুলিশ এই পাঁচ জনের মধ্যে কেবল এজাহারভুক্ত আসামি অপুকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে। অন্যদের কারও সঙ্গে হত্যা ঘটনায় সম্পৃক্ততা পায়নি। এ কারণে তাদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে। সূত্র জানায়, গত ২৫শে সেপ্টেম্বর সিয়াম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে ঘটনার সঙ্গে নিজে সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে আরও কয়েকজনের নাম বলেছে। তবে এ সব নামে জাহিদুল ইসলাম সোহেল, বিল্লাল হাওলাদার, কামাল, রাহাজুল ওরফে রাজুর নাম বলেনি। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদে সে এদের চেনেও না বলে জানিয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও গ্রেপ্তারকৃতদের স্বজনেরা জানান, র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সোহেলের পুরো নাম জাহিদুল ইসলাম সোহেল। সে বোনম্যারো ক্যানসারে আক্রান্ত। সৌদি প্রবাসী সোহেল ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার চিকিৎসার জন্য দেশে চলে আসে। গত ২৯শে আগস্ট সকালে বাড্ডার স্ত্রীর বড় বোনের বাসা থেকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়া হয়। এরপর দফায় দফায় স্বজনরা র‌্যাব-পুলিশের কাছে গেলেও কেউ তাকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি। প্রায় এক মাস পর গত শনিবার র‌্যাব-৩ এর পক্ষ থেকে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে সোহেলকে হাজির করা হয়। এ সময় র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, সোহেল মগবাজারের তিন খুনের মামলার ১০ নম্বর আসামি। তার পিতার নাম ওমর আলী খান। কিন্তু তার প্রকৃত নাম জাহিদুল ইসলাম সোহেল। পিতার নাম ইউনূস আলী। আর ঘটনার পরপরই ডিবি এজাহারভুক্ত ১০ নম্বর আসামি সোহেলকে গ্রেপ্তার করে। মামলার বাদী কালাচান তাকে শনাক্ত করে। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ভুল সোহেলকে বাদীর সামনে হাজির করলে বাদীও সে জড়িত নয় বলে জানান। এমনকি গতকাল আদালতে গিয়েও একই কথা বলেন বাদী কালাচান ওরফে শামীম। পরে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে। সোহেলের স্ত্রী তাসলিমা আক্তার সাথী ক্ষোভ ও কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, একজন নিরপরাধ ও অসুস্থ মানুষকে এভাবে এক মাস কেন আটকে রাখা হলো? দেশটা কি মগের মুল্লুক হয়ে গেছে, দেশে কি কোন আইন-কানুন বলে কিছু নেই? যাকে ইচ্ছা হবে ধরে নিয়ে যাবে?’ তিনি জানান, গতকাল আদালতে অন্য একটি বিষয় নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় সোহেলের জামিন হয়নি। আগামী মঙ্গলবার জামিন হতে পারে।
গ্রেপ্তারকৃত বিল্লালের স্বজনেরা জানান, গত ২রা সেপ্টেম্বর মগবাজারের পিডাব্লিউডি কোয়ার্টার থেকে বিল্লাল হাওলাদারকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে নিখোঁজ ছিল বান্দরবানের রুমায় পোস্টিং হওয়া নির্বাচন কমিশনের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বিল্লাল। দু’দিন পর গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী বেবী আক্তার বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি অপহরণ মামলা (নং ৮) দায়ের করেন। মামলাটি বর্তমানে সিআইডি তদন্ত করছে। এদিকে গত শনিবার সোহেলের সঙ্গে বিল্লালকেও গ্রেপ্তার দেখায় র‌্যাব। ডিবির কাছে হস্তান্তরের পর মামলার বাদী কালাচান জানায়, এই বিল্লাল এজাহারনামীয় আসল বিল্লাল নয়। ভুল বিল্লালকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। পরে ডিবি তাকে ৫৪  ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে। অপরদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও রাহাজুল ইসলাম খান ওরফে রাজুর স্বজনরা জানায়, রাজু পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের কপালবেড়া গ্রামের শহীদুল ইসলাম খানের ছেলে। সে সম্প্রতি সুবিদখালী ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। অনার্সে ভর্তি হওয়ার জন্য সে ঢাকার সায়েদাবাদের গোপীবাগে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছিল। সায়েদাবাদ এলাকা থেকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে তাকে তুলে নেয়ার পর গত শনিবার র‌্যাব তাকে গ্রেপ্তার দেখায়। তার বিরুদ্ধেও খুনের সঙ্গে কোন সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় ৫৪ ধারায় আদালতে সোপর্দ করেছে পুলিশ। আর কামাল ওরফে জাউড়া কামাল নামে র‌্যাব যাকে কাইল্যা বাবুর ঘনিষ্ঠ বলে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে সেই কামাল আসলে ডিশ ব্যবসায়ী। ইস্কাটনের বিয়াম গলি কানাডা প্রবাসী শামীম নামে এক ব্যক্তির ‘লাইন এরিয়া’ নামে প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। গত ২৯শে আগস্ট ৩৩৬ নম্বর মগবাজারের বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় প্রশাসনের লোক পরিচয়ে। কামালের স্ত্রী রুনা জানান, ঘটনার পরদিনই তারা রমনা থানায় একটি জিডি করেন। এছাড়ার প্রতিদিনই স্বামীর খোঁজে র‌্যাব-পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কেউ তাকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করেনি। প্রায় এক মাস পর র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, মগবাজারের ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় সে জড়িত। অথচ ঘটনার সময় সে ইস্কাটনে ছিল। ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কামালের বিরুদ্ধেও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। বাদী কালাচানও তাকে চিহ্নিত করতে পারেনি। এ কারণে তাকে ৫৪ ধারায় আদালতে পাঠানো হয়েছে।
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, আমরা যথেষ্ট গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করেই সাধারণত আসামিদের ধরে থাকি। আসামি ধরার পর মামলার তদন্ত সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা যাচাই-বাছাই করে দেখে কারা জড়িত কারা জড়িত নয়। তিনি বলেন, অপরাধীরা সবসময় অপরাধ করে লুকিয়ে থাকে। তার পরিবারের লোকজন খুঁজে না পেয়ে বলে ‘প্রশাসনের লোক’ ধরে নিয়ে গেছে। র‌্যাব কাউকে ধরে নিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রাখে না।

No comments

Powered by Blogger.