এক টাকা আসলে এক টাকা নয় by সামছুর রহমান

শায়েস্তা খাঁর আমলে আট মণ চাল পাওয়া যেত। ৫০ বছর আগে পাওয়া যেত আস্ত একটি মুরগি। গত শতাব্দীর শেষের দিকেও মিলত মুরগির একটি ডিম। এখন বড়জোর পুঁচকে একটা লজেন্স। এক টাকার ক্রয়ক্ষমতার ধারাবিবরণীটা এমনই। বাজারের বাস্তব পরিস্থিতি যা, তাতে শিগগিরই হয়তো এক টাকা চলে যাবে সিকি, আধুলি তথা ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সার কাতারে। স্থান হবে টাকার জাদুঘরে। এক টাকার কাগুজে নোট বা ধাতব মুদ্রাটি ব্যাংক নোট নয়, এটি সরকারের। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়ে এই টাকা বা কয়েন ছেপে বাজারে ছাড়ে। লেনদেনে এক টাকার ব্যবহার প্রায় উঠে যাচ্ছে। খুচরা দেওয়ার সময় দোকানি এক টাকার বদলে একটা লজেন্স ধরিয়ে দিচ্ছেন। বাসভাড়া, রিকশাভাড়াসহ কেনাকাটায় এক টাকা কম বা বেশি দিতে বা নিতে হচ্ছে।

এক টাকার বদলে লজেন্স দেওয়ার পেছনে অবশ্য দোকানিদের ব্যবসায়িক স্বার্থটাই টনটনে বলে মনে হলো। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কয়েকটি চা-সিগারেটের দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১০০ লজেন্সের একটি প্যাকেট তাঁরা কেনেন মানভেদে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। চা বা সিগারেটের ক্রেতাদের এক টাকার বিনিময় পণ্য হিসেবে ১০০ লজেন্স গছিয়ে দিতে পারলে লাভ হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা!
বাসে এই চিত্রটা কেমন? মিরপুর ১ নম্বর থেকে নিউ ভিশন পরিবহনে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া দাবি করা হয় ১৩ টাকা। আর মতিঝিল পর্যন্ত ২৩ টাকা। নিউ ভিশনের একটি বাসের সহকারী মো. ফারুক বলছিলেন, ‘যাত্রীরা হয় ১২, না হয় ২২ টাকা দেয়। এক টাকার লাইগ্যা খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে ভালো লাগে না।’
আবার যাত্রী কাজল শাহর অভিজ্ঞতা ভিন্ন। ৩ নম্বর বাসে ফার্মগেট থেকে এয়ারপোর্ট স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া ১২ টাকা। কিন্তু ১৫ টাকা দিলে কন্ডাক্টর ফেরত দেন দুই টাকা। মানে, ভাড়া নিয়ে নেন ১৩ টাকা। এক টাকা কি তবে তুচ্ছ হয়ে গেছে? নাকি বাজারে এক টাকার সরবরাহ না থাকায় ভাংতির আকাল পড়েছে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহা অবশ্য বলছেন, সরবরাহের কোনো সংকট থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বাজারে এক টাকার ধাতব মুদ্রা বা কয়েন ছেড়েছে ২০০ কোটি ১০ লাখ ৭৫ হাজার ৩১২টি। আর এক টাকার কাগুজে নোট ছেড়েছে ৪২ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ৬২১টি।
খোঁজখবরে দেখা গেল, এক টাকার লাপাত্তা হওয়ার পেছনে নোট আর কয়েনের দ্বন্দ্বও একটা কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংক এক টাকার নোটের প্রায় পাঁচ গুণ বেশি কয়েন বাজারে ছেড়েছে। সামনে আরও কয়েন ছাড়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আগামী কয়েক বছরের সম্ভাব্য চাহিদা মেটানোর মতো এক টাকার কয়েন মজুত আছে।
ব্যাংক সূত্র জানায়, কয়েনের চেয়ে নোট ছাপার খরচ বেশি। আবার বেশি ব্যবহারের কারণে এক টাকার নোট অল্প দিনেই ছিঁড়ে-ফেটে যায়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আর এক টাকার কাগুজে নোট ছাপাতে চায় না।
কিন্তু যেকোনো মূল্যমানের কয়েনই নাকি বাজারে কম চলে। শুভংকর সাহা বলছেন, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই ছোট মূল্যমানের টাকার বদলে কয়েন ব্যবহার করা হয়। সেসব দেশে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে পণ্য বা টিকিট কিনতে ওই কয়েন কাজে লাগে। বাংলাদেশে সেই ব্যবস্থা নেই। কয়েনের প্রয়োজনীয়তাও তাই কম।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের টাকা জমা রাখে। ফেরত নেওয়ার সময় প্রতি ১০০ কোটি টাকার এক লাখ নিতে হয় কয়েনে। কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্তৃপক্ষ বলছে, সেসব কয়েন তাদের গুদামেই (ভল্ট) পড়ে থাকে।
ঢাকা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় দায়িত্বরত নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকেরা কয়েন নিতে চান না। বিশেষত এক টাকা, দুই টাকার নোটই তাঁরা পছন্দ করেন। তাঁর মতে, গ্রাহক চাহিদার কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত কয়েনের বদলে ছোট মূল্যমানের নোট বাজারে ছাড়া।
নোট বনাম কয়েনের এই টানাপোড়েন মৃতপ্রায় এক টাকাকে আরও অচল করে দিচ্ছে বলেই বাজার ঘুরে মনে হলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এক টাকা ছাড় দেওয়ার কারণে পণ্য বা সেবার দাম এক টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এটা মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে। মুদ্রানীতি নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এম এ তসলিম বললেন, পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি হতেই থাকে। এতে লেনদেনের চলতি একক বা ইউনিট একটা সময়ে গিয়ে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক শুভংকর সাহার মতে, লেনদেনে এক টাকা ছাড় দেওয়ার যে চর্চা গড়ে উঠেছে, তা পাল্টানো দরকার। একদিকে অনেক কয়েন মানুষের ঘরে পড়ে থাকছে। অন্যদিকে, সবাই এক টাকা করে ছাড় দিতে দিতে অনেক বড় অঙ্ক লেনদেনের হিসাব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.