খুলনাজুড়ে ইয়াবার থাবা by রাশিদুল ইসলাম

খুলনায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ইয়াবার ব্যবহার। গাঁজা, ফেনসিডিল ও হেরোইনের পর মাদকসেবীদের নেশার তালিকায় এখন যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট ইয়াবার নাম সংযুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ওই নেশার প্রথম শিকার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৫ হাজার পিস ইয়াবা বিকিকিনি হচ্ছে খুলনায়। অবৈধ এ ব্যবসার সঙ্গে খুলনায় ১০ জন পাইকারী এবং ২৫ জন খুচরা বিক্রেতা জড়িত রয়েছে বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা পুলিশের সূত্রে জানা গেছে। আর এসব ব্যবসায়ীদের প্রথম টার্গেটে রয়েছে স্পর্শকাতর ও জনবহুল প্রতিষ্ঠানসমূহ। পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১২ই সেপ্টেম্বর গভীর রাতে নগরীর পূর্ব বানিয়াখামার লোহার গেট এলাকা থেকে ৪২ পিস ইয়াবাসহ স্থানীয় ৯নং চৌধুরী গলির বাসিন্দা কামরুল হোসেন কনি (১৯) ও পূর্ব বানিয়াখামারের ৪নং বি কে মেইন রোডের বাসিন্দা জাকিরুল ইসলাম (২২) এবং টুটপাড়া মহিরবাড়ী খালপাড় এলাকার ট্যারা পান্না নামের তিন যুবককে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। এর আগের দিন ১১ই সেপ্টেম্বর বিকালে খালিশপুরের গোয়ালখালী এলাকা থেকে ১০ পিস ইয়াবাসহ মো. রাহাত শেখ (২১)কে গ্রেপ্তার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ। সে মুজগুন্নি উত্তরপাড়ার মসজিদ রোডের বাসিন্দা। আবার গত ৮ই সেপ্টেম্বর দুপুরে কেডিএ এভিনিউ এলাকার খলিল চেম্বার সংলগ্ন ছোবা বস্তি এলাকা থেকে জামাল সরদারকে (৩৫) পুলিশ দুই পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজা সুলতানা পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে সাতদিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর দুপুরে খালিশপুর এলাকা থেকে ৯৫ পিস ইয়াবাসহ দৌলতপুরের জাহিদুল ইসলামের ছেলে সোহেল হোসেন রানা (২৪)কে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর ৪ঠা সেপ্টেম্বর বিকালে শেরেবাংলা রোডের হিমু লেন থেকে ৫০ পিস ইয়াবাসহ স্থানীয় মরহুম হাজী আবদল কাদেরের ছেলে আবুল কালাম (৪২)কে আটক করে মাদবদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এরপর ২ সেপ্টেম্বর খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের কালু মিস্ত্রির চায়ের দোকানে অভিযান চালিয়ে ৫০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। এ সময় সাতক্ষীরার উত্তর ফিংড়ি হুজুরবাড়ির বাসিন্দা মৃত আবদুর রহিম সরদারের ছেলে মো. রাজু আহমেদ (২৫)কে গ্রেপ্তার করা হয়। ১লা সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রূপসা ব্রিজের পশ্চিমপাড় এলাকা থেকে ১ হাজার ২০০ পিস ইয়াবাসহ মো. ইকবাল হোসেন (৩২) নামের একজন মাদক বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করে। চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জের সাতসাইল গ্রামের ইকবাল হোসেন পুলিশকে জানায়, সে চট্টগ্রাম থেকে খুলনায় ইয়াবার চালান পৌঁছানোর দায়িত্বে ছিলেন। ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে পুলিশের কাছে খুলনা মহানগরীর কতিপয় রাজনৈতিকের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেন তিনি। গত ৫-৬ই সেপ্টেম্বর লবণচরা থানায় দু’দিনের রিমান্ডে সে পুলিশকে জানায়, প্রায় প্রতি রাতেই খুলনাতে ইয়াবার চালান নিয়ে এসেছে। তার শুধু দায়িত্ব ছিল পার্টির কাছে পৌঁছে দেয়া। সে এই চক্রের কয়েকজনের নাম প্রকাশ করলেও সূত্রটি তা জানাতে রাজি হয়নি। তবে খুলনার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কতিপয় ব্যক্তি ইয়াবা বিক্রির হোতা বলে জানিয়েছে। খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর উপ-আঞ্চলিক কার্যালয়ের সূত্র জানায়, নগরীর টুটপাড়া, বানিয়াখামার, নিরালা, শেখপাড়া, গল্লামারী, নতুনবাজার, লবণচরা, খালিশপুর, দৌলতপুর ও ফুলবাড়িগেট এলাকায় ১০ থেকে ১২ জন পাইকারি বিক্রেতা নিয়মিত ইয়াবা বিক্রি করছে। একই সঙ্গে প্রায় ২৫ জন খুচরা বিক্রেতা সরাসরি ইয়াবাসেবীদের কাছে সরবরাহ করছে। প্রতি মাসে গড়ে খুলনায় ৫ হাজার পিস ইয়াবা বিকিকিনি হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা সাড়ে ৩০০ টাকা হারে প্রতি পিস ট্যাবলেট বিক্রি করে বলে জানা যায়। পুলিশকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা করছে এমন অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে শ্রেণী-পেশার মানুষের তুলনায় উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, নগরীর যেসব হোটেলগুলোতে অনৈতিক কাজ হয়, সেখানে ইয়াবা ট্যাবলেটের ব্যবহার বেশি। সে হিসেবে ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় নিউ মার্কেটে, বৈকালি ঝুড়ির ভিটা, মুজগুন্নি স্টেডিয়ামের পাশে, ফুলবাড়িগেট ও বয়রা এলাকার একটি হোস্টেলে এবং নগরীতে অভিজাত শ্রেণীর পাশাপাশি ছোটখাট হোটেলে চলছে বেচাকেনা ও সেবনের কাজ। বড় বাজার সংলগ্ন কালীবাড়ী, হেলাতলা, থানার মোড়, ক্লে রোড ও তার আশপাশের এলাকা, পিকচার প্যালেস মোড়, ডাকবাংলা, রয়েল মোড় দৌলতপুরসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে ৮০টির অধিক অভিজাত ও সাধারণ হোটেলে ইয়াবা সরবরাহ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে পুলিশের কাছে। এ ছাড়া খুলনার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ইয়াবা’র বেচাকেনা চলছে বলে জানিয়েছেন সূত্রটি। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (গোয়েন্দা) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ জানান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স লেবেলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বাড়ছে। খুলনা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-আঞ্চলিক পরিচালক পারভীন আক্তার জানান, যতটুকু জানতে পেরেছি প্রতিমাসে খুলনায় প্রায় শ’খানেক মামলা হচ্ছে। মোবাইল কোর্টে সাজা না দিয়ে মামলা দায়ের হলে ৫-৬ বছর লেগে যায় নিষ্পত্তিতে। তখন অনেক অপরাধী প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যেতে পারে। ফলে সমাজকে ইয়াবার ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

No comments

Powered by Blogger.