গারদখানা by আল-আমিন

‘পাশাপাশি তিনটি গারদখানা। বাইরে কড়া রোদ- অথচ ভেতরে লাইট জ্বলছে। অসহ্য গরম। তিনটি গারদখানার একটি মাত্র বাথরুম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ময়লা। ভেতরে ঠাসাঠাসি অবস্থায় হাজতিরা।’ এ হলো রাজধানীর পল্টন থানার গারদখানার চিত্র। শুধু পল্টন নয়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি)’র প্রায় প্রতিটি থানার গারদের একই অবস্থা। অনেক সুস্থ হাজতি গারদের এ অবস্থায় থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এই চিত্র আদালতের হাজতেও। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য কোন অপরাধ বা মামলায় গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে শাস্তি হয়।
কারও কারও কারাবাস করতে হবে। তবে বড় শাস্তি এই গারদবাস। থানা গারদের পরিবেশের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান মানবজমিনকে বলেন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তার নাগরিকদের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীর থানা গারদগুলো দেখলে মনে হয় সেগুলোতে জন্তু ও জানোয়ারকে রাখা হয়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার হয়ে যে কোন ব্যক্তি পুলিশের হাতে আটক হতে পারেন। পরে তাকে নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে থানা অথবা ডিবি পুলিশের গারদে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু, গারদগুলোর ব্যবস্থাপনা ও বাথরুম দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ কোন সভ্য রাষ্ট্র নয়। সরজমিন পল্টন থানায় গিয়ে দেখা গেছে, সোমবার সকালে গারদের সামনে ডিউটি করছিলেন ওই থানার কনস্টেবল তসলিম আহমেদ। পরে তিনি এই প্রতিবেদককে থানা গারদের একটি কক্ষ দেখালেন। ওই কক্ষের মধ্যে দু’দিকে ১০০ পাওয়ারের দু’টি লাইট জ্বলছে। ওই গারদখানার ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩০ জনের। কিন্তু, সেখানে রাখা হয়েছে প্রায় ৪০ জনকে। পল্টন থানার ওসি জানালেন, রাতের বেলায় অভিযানে সন্দেহভাজন হিসেবে তাদেরকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হতে পারে। পল্টন থানার বাইরে অপেক্ষমাণ এক হাজতির বড় ভাই রফিকুল ইসলাম জানান, রাজধানীর শান্তিনগরের ৩৪/২-এ নম্বর বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকেন তার ছোট ভাই রাসেল। রাত ২টায় কাকরাইলের মোড়ে তার ছোট ভাই বন্ধুদের সঙ্গে চা খাচ্ছিল। এ সময় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিবাদ হয়। তখন হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরপর টহল পুলিশ সেখান থেকে পাঁচজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। থানা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে আনা হয়েছে। কিন্তু, এখন পর্যন্ত তাদেরকে ছাড়া হচ্ছে না। থানার বাইরে অপেক্ষমাণ থানা গারদে থাকা অন্য এক হাজতির চাচা আবদুর রউফ জানান, তিনি পুরানা পল্টনের দক্ষিণ গলিতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তার ভাইপো আসাদুজ্জামান রাতের বেলায় মাতাল হয়ে প্রাইভেট কার চালাচ্ছিল। পরে পুলিশ তাকে পল্টন মোড় থেকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে। আটকের খবর পেয়ে থানায় আসি। তিনি আরও বলেন, তার বড় ভাই আমেরিকাতে থাকে। ভাইপোর দেখাশোনা  তাকেই করতে হয়। থানায় এসে পরে গারদে তার ভাইপোর সঙ্গে দেখা হয়েছে। গারদের অবস্থা দেখে মনে হলো একজন সুস্থ লোক সেখানে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। পল্টন থানার ওসি মোর্শেদ আলম মানবজমিনকে জানান, থানা গারদ তো আর সুখ করার স্থান না। তবুও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি পল্টন থানার গারদটি পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখতে। এটি মিডিয়াম মানের। তিনি স্বীকার করে বলেন, এখানে সর্বোচ্চ মানের সুযোগ সুবিধা নেই। অন্যদিকে, মতিঝিল থানার গারদ দেখে ভিন্ন এক চিত্র পাওয়া গেল। সেখানকার গারদের মধ্যে নেই কোন আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। দিনের বেলায় তিনটি লাইট জ্বলছে। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই। টয়লেটের ময়লা উপচে পড়ছে। বাধ্য হয়ে অনেক হাজতি তার ওপরই প্রাকৃতিক কর্ম সারছেন। তার পাশেই আরেকজন হাজতি দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। গারদের মধ্যে থাকা এক তরুণ হাজতিকে কান্নারত অবস্থায় দেখা গেল। তিনি চিৎকার করে বলছেন, ‘আমি নির্দোষ আমি নির্দোষ। আমাইরে ছাড়াইয়া দেন।’ এদিকে, তেজগাঁও থানার গারদে দেখা যায়, পাশাপাশি দু’টি কক্ষ। পাশে খোলা একটি বাথরুম। যে গারদে ১০ জন থাকার কথা সেখানে প্রায় ২০ জনকে রাখা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার গিয়ে দেখা যায়, তিনটি কক্ষকে গারদখানা বানানো হয়েছে। পুরো গারদখানা অন্ধকারাছন্ন। আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই। পানির অভাব। থানার মধ্যে এক হাজতির চিৎকার শোনা গেল। পুলিশ জানালো একজন আসামির রিমান্ড চলছে। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। হাজতির অনেক আত্মীয়স্বজনকে থানার সামনে ভিড় করতে দেখা গেল। অনেকক্ষণ ধরে তারা অপেক্ষা করছেন আটক হাজতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। যাত্রাবাড়ী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, প্রতি পাঁচ দিন পর পর একজন এসে থানার গারদটি পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। যাত্রাবাড়ী থানার ওসি অবনী শংকর রায় জানান, যাত্রাবাড়ীর থানা গারদ মোটামুটি ভাল মানের। তবে কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো  সমাধান করা হচ্ছে। আমরা হাজতিকে সুযোগ সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করি। সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের ডিসি মাসুদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, রাজধানীর ডিবি, থানা ও কোর্টের  গারদগুলো সর্বোচ্চ পরিষ্কার ও পরিছন্ন রাখার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এটি বর্তমান ডিএমপি কমিশনারের কঠোর নির্দেশ। তারপরও কোন থানা এ বিষয়ে গাফলতি দেখালে তাদেরকে জবাবদিহির জন্য নোটিশ দেয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.