আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান?

আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? যে প্রশ্নের উত্তর ‘না’ দিয়ে করা যায় না, তার উদাহরণ হিসেবে এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আপনি যদি বলেন, ‘হ্যাঁ’, তাহলে তো জানাই গেল ব্যাপারটা। কিন্তু যদি বলেন, না, তাহলে কিন্তু আপনার হাত পরিষ্কার হয় না। মানেটা দাঁড়ায়, এখন পেটান না বটে, তবে আগে পেটাতেন। বা আগে বেশ জোরেশোরে পেটাতেন, এখন অতটা জোর নেই, বা আগের পদ্ধতির চেয়ে এখনকার পদ্ধতিটা খানিক বদলে ফেলেছেন। না, আমি কখনোই স্ত্রী নির্যাতন করিনি, শুধু ‘না’ দিয়ে এই প্রশ্নের সেই উত্তর দেওয়া যায় না। এই শিরোনামটার জন্যও আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিতে হবে। আমাদের ভাষা তো আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারারই প্রতিচ্ছবি। বউ পেটানো কথাটার মধ্যে তাচ্ছিল্যের ভাব আছে, তুচ্ছতার ভাব আছে। যেন স্বীকার করেই নেওয়া হচ্ছে, স্ত্রীকে মারধর করাটা বেশ একটা চল। বাংলায় প্রবাদ আছে, ‘ঢোল ও মেয়েমানুষ মাইরের ওপরেই রাখতে হয়!’ যেহেতু আমরা বাংলাদেশের পুরুষেরা বেশির ভাগই ঘরের মধ্যেই নারী-নির্যাতন করে থাকি, তাই আমাদের ভাষায় এ ধরনের বাগ্ধারা প্রচলিত হতে পেরেছে। প্রথম আলোয় খবরটি বেরিয়েছিল ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উমেন ২০১১’ শিরোনামে জরিপ পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনোভাবে কোনো না কোনো দিন নির্যাতিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানটা বেশ উদ্বেগজনক।
তার মানে, আমরা যদি ১০ জন বিবাহিত পুরুষকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে দাঁড় করাই, এর নয়জনই কোনো না কোনোভাবে স্ত্রী নির্যাতন করেছেন। বিবাহিত জীবনে নারী-পুরুষের ঝগড়াঝাঁটি-মনোমালিন্য হবে না, সে কথা কেউই বলবে না। কিন্তু নারীদের যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নিশ্চয় এই ৮৭ ভাগ নারীর মনে এই বেদনা ছিল যে তাঁদের স্বামীর আচরণটা নির্যাতনের পর্যায়েই পড়ে, তাই তাঁরা এটা বলেছেন। এই ৮৭ ভাগের মধ্যে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক নির্যাতন আছে। আচ্ছা, তাহলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন কতজন? সেই সংখ্যাটাও বেশ ভীতিকর। প্রায় ৬৫ ভাগ নারী বলেছেন, তাঁরা স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার মানে, আপনি যদি এলোপাতাড়িভাবে তিনজন পুরুষকে দাঁড় করান, তাঁদের দুজন স্ত্রীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছেন। এখানে আসে এই রচনার শিরোনামটা: আপনি কি আগের মতোই বউ পেটান? তিন ভাগের দুই ভাগ পুরুষকে বলতে হবে, ‘হ্যাঁ।’ শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে ৪৫ ভাগ নারী স্বামীর চড় বা ঘুষিতে আহত হয়েছেন, ১৫ শতাংশ লাথি বা মারধরের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যাটিও ভয়াবহ উদ্বেগজনক। পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রথম আলোর ২৩ জানুয়ারির মানসুরা হোসাইনের আলোচ্য প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ইউরোপে চারজন নারীর মধ্যে একজন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। ভারতের একই জরিপে বলা হয়েছে, ৪৪ ভাগ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানটা বেশ ভয়াবহ। এবং লজ্জাজনক। অথচ আমরা মানবোন্নয়ন সূচকে নানা দিক থেকে ভালো করছি। শিশুমৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি বিস্ময়কর। নারীর ক্ষমতায়নে নানা দিক থেকে আমরা বেশ উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করছি। হয়তো আমাদের জরিপে যে এত বেশিসংখ্যক নারী সত্য উচ্চারণে এগিয়ে এসেছেন, সেটা সেই অগ্রগতিরই একটা লক্ষণ। নারীরা মুখ খুলছেন। কিন্তু একজন পুরুষ হিসেবে গোটা পরিসংখ্যানটা আমার জন্য চরম লজ্জার। আমিই হলাম এ ক্ষেত্রে অপরাধী। দশজন পুরুষের নয়জনই যখন নির্যাতন করেন, তাঁদের মধ্যে আমিও আছি। পারিবারিক নির্যাতন এবং তা প্রতিরোধের আর্থিক হিসাব ও করণীয় সম্পর্কে সিপিডির একটা গবেষণাপত্র নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যা প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। সেই আলোচনায় বক্তারা খুব জোর দিয়েছেন এই বিষয়টির ওপরে যে আমাদের সমাজে পারিবারিক নির্যাতনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। একজন আলোচক এ-ও বলেছেন, সরকারি কোনো কমিটিতে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা উঠলে এমনকি নারী সদস্যদেরও কেউ কেউ বলে থাকেন যে এটা তেমন কোনো সমস্যাই নয়। এ আর এমন কী! এই হলো সমাজের মনোভাব। প্রথম আলোয় ৮ মার্চ ২০১৪ প্রকাশিত আরেকটা প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে আইসিডিডিআরবির গবেষণার ফল: দেশের ৮৯ ভাগ পুরুষ মনে করে, স্ত্রী অন্যায় করলে মার দেওয়া যায়! কাজেই, পারিবারিক নির্যাতন যদি প্রতিরোধ করতে হয়, এটাকে একটা সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সবাই মিলে একযোগে আওয়াজ তুলতে হবে যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়। সেটা করতে হবে সমাজের সর্বস্তরে।
যেমন গণমাধ্যমকে জনমত গড়ে তুলতে হবে, শিল্পে-সাহিত্যে-নাটকে-সংগীতে নারী নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, তেমনি সরকারকে, তেমনি সিভিল সমাজকে এই নিয়ে সরব, সোচ্চার, সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এখন পর্যন্ত বিষয়টা মনে হয় যেন দাতাদের মাথাব্যথার ব্যাপার। আমরা বউ পেটাই, তাঁর নীরব বা উচ্চ স্বরের কান্না যেন একমাত্র শুনতে পায় দাতারা, উন্নয়ন-সহযোগীরা, জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো, এনজিওরা। যেন এটা আমাদের ইস্যুই নয়। এই মনোভাবটার পরিবর্তন করা দরকার সবার আগে। অবশ্য নিশ্চয়ই বলতে পারি, সবকিছুর জন্য দায়ী পিতৃতন্ত্র। ছোটবেলা থেকেই একটা ছেলে পুরুষ হয়ে ওঠে, আর সমাজ নারীকে নারী করে তোলে। সমাজের মনোভঙ্গির ভেতরেই থাকা নারী হলো ইতরতর, দুর্বল, সুতরাং নির্যাতনের যোগ্য। কাজেই পিতৃতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। কথাটা বলা সোজা, করা কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র এখনো একজন নারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে পারেনি। তারা নারীদের ভোটাধিকারই দিয়েছে মাত্র সেদিন। সমাজের আগাগোড়া মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো দরকার। নারী ও পুরুষ যে সব দিক থেকে সমান, নারীর প্রতি এই সম্মানবোধটা সর্বক্ষেত্রে জাগিয়ে তোলা দরকার। সে কারণেই হয়তো এখন খুব করে বলা হচ্ছে নারীর অর্থনৈতিক অবদানের কথা। বলা হচ্ছে, যে নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করেন, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমাদের গার্মেন্টস-কর্মীরা, তাঁদের অবদান তো আছেই, কিন্তু আছে অনেক অস্বীকৃত অবদান। ঘরের মধ্যে নারী যে অবদান রাখছেন, তার কোনো অর্থনৈতিক স্বীকৃতি নেই। আমাদের কৃষক পরিবারগুলোয় নারীরা অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেন, অনেক ক্ষেত্রে ধানমাড়াই থেকে শুরু করে ধান সেদ্ধ করা, শুকানো, বীজ সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা কাজে সরাসরি অংশ নিলেও সেসবের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই।
এই স্বীকৃতি না থাকা থেকেও নারীকে অধস্তন বলে ভাবনাটা চলে আসে। ৮ মার্চে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর আরেকটা গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে নারীদের গৃহস্থালির কাজের অর্থমূল্য হিসাব করা হয় না। এটা করা গেলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান আড়ালে থেকে যেত না।’ কাজেই, আজ যে আওয়াজ উঠেছে, নারীকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে, ঘরে-বাইরে তাঁর অপরিসীম অবদানের জন্য, আর তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, তাঁকে বলতে হবে, স্যরি, দুঃখিত। কারণ, তাঁর এই অবদানের স্বীকৃতি দিইনি আমরা এত দিন, সেই আওয়াজে আমাদের সব পুরুষকেই কণ্ঠ মেলাতে হবে। নারীর সামনে নতজানু হয়ে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা দেখার পর নিজেদের অপরাধী ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। রাষ্ট্রের নিশ্চয় করণীয় আছে, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গেও এসবের সম্পর্ক আছে, দৃষ্টান্তমূলক সাজাও অপরাধ কমিয়ে আনে। সব ঠিক, কিন্তু আমার নিজের ঘরে যদি নারী আমার দ্বারা নির্যাতিত হন, তাহলে তার দায় তো আমারই। আমি জানি না, ক্ষমা চাইলেই সেই অপরাধের দায় থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারব কি না। এই পরিসংখ্যানের আরেকটা দিক খুবই উদ্বেগজনক। ইচ্ছার বিরুদ্ধে নারীরা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সে ৪১ দশমিক ৮ ভাগ যৌনতার শিকার হয়, ১৫ থেকে ১৯ বছরে হয় আরও ৩৪ দশমিক ৩ ভাগ। তাহলে ৭৬ ভাগ নারী ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেই যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কী ভয়াবহ তথ্য! কাজেই, এই রচনাটার শিরোনামটিই আবার বলতে হয়। আপনি কি আগের মতোই নারী নির্যাতন করেন? আপনি কি আগের মতোই অনিচ্ছুক নারীর ওপরে বল প্রয়োগ করেন? এই প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক নয়। হয়তো আপনি বলবেন, 
না, আমি করি না, কখনোই করিনি।’ কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার পাশে দাঁড়ানো আর নয়জন এই কাজ করেছেন। নারীর ওপরে যৌন নির্যাতন যদি ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে, তার পেছনে নিশ্চয়ই ৮০ ভাগ পুরুষ জড়িত। কাজেই বলা যাবে, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচজন পুরুষের মধ্যে চারজনই এই কাজ করেছেন। কী বলব। লজ্জাই পাই শুধু। সত্যি সত্যি, পারিবারিক নির্যাতনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা একটা বড় বাধা। পুরুষবাদী মানসিকতা তো আছেই। আমাদের এই গ্রহণযোগ্যতার বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, বলতে হবে, ঘরের মধ্যে নারী নির্যাতন চলতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুলে বাংলাদেশের অনেক ক্ষেত্রে অনেক উন্নতিই তো ঘটাতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে না পারার কোনো কারণ দেখি না। একই কথা বলব বাল্যবিবাহ বা কৈশোরবিবাহের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে ৬৭ ভাগ মেয়েরই আইনি বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এর পেছনেও নিশ্চয়ই সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাবও কিন্তু কম দায়ী নয়। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুললে এই অপরিণত বয়সের বিয়েও আমরা রোধ করতে পারব। বাল্যবিবাহও কিন্তু পারিবারিক নির্যাতনের অন্যতম কারণ।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.