আমারে এখন নামাইব ক্যাডা?

বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের কথা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের দেশীয় দুই রাজনৈতিক পরাশক্তি ঠান্ডা যুদ্ধের পরোয়া করে না, তাদের যুদ্ধটা অতীব গরম। সবই ঘটছে ক্ষমতার ক্ষুধার জন্য। এক ক্ষুধার্ত যুবকের গল্প বলি। সে মেলায় ঢুকেছে, কিছু লাভ হয় কি না দেখতে। সার্কাস তাঁবুর সামনে একটা নোটিশ ঝোলানো দেখতে পেল। সেখানে আহ্বান জানানো আছে: যে ৫০ ফুট খুঁটির ওপর উঠে নিচের জালে লাফিয়ে পড়তে পারবে, তাকে দেওয়া হবে ৫০ হাজার টাকা। বেপরোয়া যুবক ভাবল, এ আর এমন কী? খুঁটিটায় তেল মাখানো ছিল না, তাই উঠতে বেগ বা আবেগ কিছুই পোহাতে হলো না। কিন্তু সমস্যা বাধল ওঠার পরে। অত ওপরে উঠে নিচে তাকিয়ে তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। ওদিকে রিংমাস্টার চেঁচাচ্ছেন, ‘লাফ দে ব্যাটা, লাফ দে, নিচে তো জাল আছে, মরবি না।’ কিসের জাল আর কিসের লাফ! যুবকটির সোজা উত্তর, ‘লাফ দেওয়া তো দূরের কথা, আমারে এখন নামাইব ক্যাডা?’ নির্বাচন করতে হলে মাঠে-ময়দানে নামতে হবে। দুই নেত্রী এবং তাঁদের সভাসদেরা কি ভেবেছেন, তাঁরা যে ক্ষমতা আর গর্বের কুতুব মিনারে উঠে বসেছেন, নামতে পারবেন তো সেখান থেকে? রাজনীতির আকাশে কত কথাই তো ওঠে আর ঝড়ে উড়ে যায়।
নির্বাচনের বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনার কথা উঠতে না-উঠতেই পড়ে গেল। এখন আর পত্রমারফত কিছু মিলবে না। এখনকার খেলার নাম ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’। রাজপথ দখলে থাকবে যার, সিংহাসন হবে তার। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালাবদল এ দেশে কোনোকালেই ঘটেনি; ঘটতে দেরি আছে। বাংলাদেশি গণতন্ত্রের ভাষা হলো বল প্রয়োগ। বল প্রয়োগের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই রাজনীতি। পারিবারিক কোন্দল থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক বিবাদ—সবখানেই বল প্রয়োগের ছড়াছড়ি। বিরোধী দলের প্রতিবাদ মানে আগুন-বোমা, সরকারি নিয়ন্ত্রণ মানে গুলি-গ্রেপ্তার-নিষেধাজ্ঞা। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো বল প্রয়োগের শক্তিতে এখানে সব চলে। এখানে সংবিধান, আইন, ন্যায়-নৈতিকতার কথা বলা বাতুলতা। দিনাজপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হুংকার দিয়েছেন। যে বিএনপি-জামায়াতকে গত পাঁচ বছরে জনস্বার্থে আন্তরিক আন্দোলন করতে দেখা যায়নি, ক্ষমতার সম্ভাবনায় তারাও পাল্টা শক্তি প্রদর্শনে মরিয়া। এসবের ডামাডোলে কাগজের চিঠি উড়ে গেছে। আসলে দুই পক্ষই জনগণকে দেখাতে চায়, তারা কতই না চেষ্টা করেছে সমঝোতার জন্য! নইলে পাতলা চিঠি দলবল নিয়ে বয়ে নেওয়ার কারণই বা কী? মির্জা আর সৈয়দের ফোনালাপের নাটক এমনভাবে করার দরকার কী, যাতে দেশবাসী টেলিভিশনে তা দেখতে ও শুনতে পায়? রাজনীতিকেরা তর্ক করেন প্রকাশ্যে,
আপস করেন গোপনে। আলোচনার লারেলাপ্পা আসলে মায়ার খেলা। এখন সংঘাতের ঝাঁকুনিতে মায়ার পর্দা সরে গিয়ে ভেতরের হিংসাত্মক মূর্তিটা বেরিয়ে পড়ছে। দেশজুড়ে বিজিবি-পুলিশ, ধারা ১৪৪। জগতে সংঘাত মীমাংসার উপায় মাত্র দুটি। হয় দুই পক্ষকে এক ঘরে ঢুকিয়ে আলোচনায় বসাও, নইলে ঠেলে দাও যুদ্ধের মাঠে। সিংহ আর ভেড়াকে একবার আলোচনার জন্য গুহায় ঢুকিয়ে গুহার মুখটা আটকে দেওয়া হলো। ঘণ্টা খানেক পর দেখা গেল সিংহ হেলেদুলে বেরিয়ে আসছে। আর ভেড়া? সে তখন সব আলোচনার ঊর্ধ্বে; সিংহের পাকস্থলীতে সাঁতার কাটছে। বাংলাদেশে সরকারি দল বনমধ্যে সিংহরাজা। বাদবাকি সবাই তার চোখে ভেড়া। উভয়ের মধ্যে আলোচনা কীভাবে সম্ভব? আলোচনা তখনই সফল হবে, যখন তৃতীয় কোনো পক্ষ উপস্থিত থেকে নিশ্চিত করবে যে, প্রথম পক্ষ দ্বিতীয় পক্ষের রান চিবাতে পারবে না। সে রকম তৃতীয় পক্ষ এখানে দৃশ্যমান না হলেও জনগণ বলে একটি কথা আছে। তারা সবই দেখছে... তাহলে কি লগি-বইঠার সঙ্গে দা-কুড়ালের যুদ্ধ হবে? কারা করবে সেই যুদ্ধ? এটা ষাট বা সত্তর বা আশির দশক নয়।
এই যুগে সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা আরাম-আয়েশ ও বিত্তবৈভবের মজমায় এতই আসক্ত, বিপদ দেখলেই তাঁদের বিদেশে পাড়ি জমানো অথবা ছোট শ্যালিকার বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে থাকার কথা মনে আসে। বিরোধী দলের কর্মীদেরও জানা আছে, আজ হোক কাল হোক নির্বাচন হবে এবং তাঁরাও জমি-বন-ব্যাংক লোপাটের বিস্তর সুযোগ পাবেন। খামাখা মরে গিয়ে সেই সুযোগ তাঁরা হারাবেন কেন। জনগণও সংঘর্ষ চায় না। ঈদ ও পূজার ছুটির আমেজ এখনো ফুরায়নি। কোরবানির গরুর গোশত যাঁদের ফুরিয়েছে, তাঁরা এখন নেহারি খাবেন, ভুঁড়ি ভাজা খাবেন। মানুষ বোঝে, মসনদে যে-ই বসুন, যাঁর যাঁর তাকিয়া বা খাটিয়া তাঁকে তাঁকেই বইতে হবে। দুই জোটের চর দখলের লড়াইয়ে তাই তাঁরা দার্শনিক দূরত্ব বজায় রাখবেন। এভাবে রাজনীতি পরিণত হয়েছে পেশাদার ও ভাড়াটে ক্যাডারদের সহিংস হোলিখেলায়। লিও টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস উপন্যাসের কাহিনির প্রেক্ষাপট ছিল ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে রাশিয়ার অবস্থা যায় যায়। ফরাসি সেনারা রাজধানী প্রায় দখল করে ফেলল বলে। রুশ সেনাপতির হুঁশ নেই।
তো তাঁর জেনারেলরা দল বেঁধে তাঁকে ধরে বসলেন। দেশ ধ্বংস হয়ে গেল, অথচ আপনি বসে বসে দেখছেন, কেমন সেনাপতি আপনি? ইত্যাদি ইত্যাদি। বৃদ্ধ সেনাপতির উত্তর: ‘ঠিক আছে, আমি তোমাদের কথা শুনব, তার আগে বলো, তোমার জনগণ কী করছে?’ জেনারেলরা হড়বড় করে বলতে লাগল: সব ভীতুর ডিম, ওরা পালাচ্ছে। সেনাপতি মিটি মিটি হাসছেন। বললেন, আর কী করছে ওরা? ব্যবসায়ীরা পুঁজিপাট্টা বাঁচাচ্ছে, কৃষকেরা পানিতে বিষ ঢেলে, খেতখামারে আগুন দিয়ে গবাদিপশুদের নিয়ে পালাচ্ছে। হাসতে হাসতেই সেনাপতি বলেন, ওরা তোমাদের থেকে বিচক্ষণ। ওরা এসব করছে, যাতে ফরাসিরা ভাতে-পানিতে, অর্থাৎ রুটি-মাংসের অভাবে আর শীতের ঠান্ডায় কাবু হয়। মানুষ জানে, এটা যুদ্ধের সময় নয়। যুদ্ধ হবে শীতকালে, যখন ক্ষুধা আর শীতে ফরাসিরা ধুঁকবে; তখনই আমরা ওদের আক্রমণ করব। সেনাপতির কথা ফলেছিল। অসম যুদ্ধের সেনাপতির প্রধান ভরসা জনগণ। জনগণই যুদ্ধের কৌশল ঠিক করে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ দুই দলের সংঘাতের মধ্য দিয়ে কিছু অর্জিত হবে বলে মনে করে না। কৃষক এখন ফসল তুলে ভালো দামের আশায় আছে, শ্রমিকেরা মজুরি বাড়ানোর সংগ্রামে ব্যস্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো আরেকটু সচ্ছলতার স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু ভাবতে নারাজ। বৃহত্তর জনগণ চায় শান্তি। বড়লোকদের কুছ পরোয়া নেই। তাদের এক পা আর অর্ধেক পরিবার তো বিদেশেই পড়ে আছে। তাঁদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে ফুরুৎ করেছেন। গণতন্ত্র কে না চায়।
তার থেকেও মানুষ বেশি চায় স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা। যাতে দারা-পুত্র-পরিজন নিয়েবেঁচেবর্তে থাকতে পারে। তাই দুই জোট একা একা যতই গরম হোক, মানুষ ভীত হলেও শান্ত। মানুষ অপেক্ষা করছে নির্বাচনের। আগে হোক পরে হোক সেটা হতেই হবে। এ দেশের মানুষ দুর্নীতি সহ্য করলেও, নির্বাচনের পথ বন্ধ করা মানে না। এমন নির্বাচনমত্ত মানুষ আর কোথাও নেই। আমাদের ইতিহাসের সব কটি পালাবদলের পেছনে ছিল ঐতিহাসিক নির্বাচন। ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পর মহাজনি ব্যবস্থা উচ্ছেদ হয়েছিল, ১৯৪৬-এর নির্বাচনের পর স্বাধীনতা যেমন-তেমন আসলে মিলেছিল জমিদারি ব্যবস্থা থেকে মুক্তি, ১৯৭০-এর নির্বাচন স্বাধীনতা অনিবার্য করে তুলেছিল। কিন্তু জনগণের ক্ষমতায়নের গণতন্ত্র একবারও আসেনি। এবারও আসবে না। তার পরও রাজনীতির পরাশক্তিগুলোর মধ্যে দেশ চালানো ও ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে স্থায়ী বন্দোবস্ত বা সেটেলমেন্ট জরুরি। হোক সেই বন্দোবস্ত এলিট মহলের মধ্যে; রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার স্বার্থে সেটা দরকার। সব অস্থিতিশীলতা বিপ্লবীসম্ভাবনা নয়। বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা বা ওঠার জায়গায় আপসের মাধ্যমে আগমন ও প্রস্থানের একটা নিয়ম তৈরি করতেই হবে। সব পক্ষ রাজি থাকলে সংবিধান কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু এটা করতে যদি দুই দলের নেতৃত্ব ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁদের অবস্থা হবে ওই যুবকের মতো, যে লোভে পড়ে খুঁটির মাথায় চড়ে আর নামতে পারেনি। তাকে ধরে নামাতে হয়েছিল। ক্ষমতা যেমন বাঘের মতো, যেমন এর পিঠে ওঠা বা নামা বিপজ্জনক, তেমনি ক্ষমতা হলো রসাতল এবং মাছির মৃত্যু হয় মিষ্টির রসে পাখনা ভারী হয়ে রসাতলে ডুবে। এই সরল দৃষ্টান্তগুলো দুই জোটেরই মনে রাখা দরকার।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.