বিধ্বস্ত রানা প্লাজার জমিতে বিপণিবিতান!

বিধ্বস্ত রানা প্লাজার বর্তমান পরিত্যক্ত জমিতে একটি নতুন বহুতল বিপণিবিতান নির্মাণ করে সেখানে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। প্রস্তাবটি দিয়েছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। খবরটি ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকের। খবরে প্রকাশ, বিজিএমইএর নতুন পরিচালনা পরিষদ রেওয়াজ অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে দেখা করতে গিয়ে এ প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ভবনধসে নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোকে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন। এসব পরিবারের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই সহমর্মিতা সর্বতোভাবে সমর্থনযোগ্য। তবে কিছু প্রশ্ন থেকে যায় বিজিএমইএর আলোচিত প্রস্তাব এবং এ-জাতীয় ঘটনায় তাদের ভূমিকা নিয়ে। কেননা, তারা রানা প্লাজার জমির কিংবা এখানে যে পোশাক কারখানাগুলো ছিল, সেগুলোর মালিক নন। এই ভবনমালিকের জমির পুরো মালিকানাও প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিযোগ রয়েছে। কিছু বেআইনি দখলকৃত জমিও এর মধ্যে রয়েছে বলে পত্রপত্রিকা থেকে জানা যায়। তবে সেটা হলেও অন্য কেউ সেই অংশের মালিক হবেন আইনি প্রক্রিয়ায়। আর তা সরকার এভাবে ব্যবহার করতে চাইলে অধিগ্রহণ করতে হবে। দিতে হবে বহু টাকা ক্ষতিপূরণ।
উল্লেখ্য, গত ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। এযাবৎ পোশাকশিল্প খাতে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ওই ধসের ফলে। এমনকি এখনতক অন্য সব পোশাকশিল্পের দুর্ঘটনায় যত লোকের প্রাণহানি হয়েছে, তার প্রায় তিন গুণ বেশি প্রাণহানি এখানে হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের অনেকেই জীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাবেন। আগের দিন ভবনটিতে ফাটল ধরলে বন্ধ করে দেওয়া হয় ওই ভবনে অবস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের কার্যক্রম। নিচের দোকানগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বন্ধ হয়নি পোশাক কারখানাগুলো। কোনো বিপদের ঝুঁকি নেই বলে ঘটনার দিন কারখানাগুলোর মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ডেকে এনে কাজে লাগায়। এ ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্যাবলি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ায় বিস্তারিত আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। ভবনটির মালিক সাভার যুবলীগের নেতা সোহেল রানা। তিনি অনুমোদিত নকশার বাইরে ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করেছেন ভবন নির্মাণসংক্রান্ত নিয়মকানুন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। নিম্নমানের মালামালও ব্যবহূত হয়েছে ভবন নির্মাণে—এমন অভিযোগও রয়েছে। এর ওপরের তলাগুলো ভাড়া দিয়েছেন পোশাক কারখানাগুলোকে। সেখানে ছিল ভারী যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক জেনারেটর। আর শ্রমঘন শিল্প বলে একত্রে কাজ করতে হয় বহুসংখ্যক শ্রমিককে। তদুপরি এই বহুতল ভবনের ভিতও যথাযথ মানের ছিল না বলে জানা যায়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম প্রকৃত চিত্র ও ঘটনা তুলে ধরেছে। ঘটনায় শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ দেশের সাধারণ মানুষ। জানা যাচ্ছে, ততোধিক ক্ষুব্ধ রপ্তানিমুখী শিল্পটির প্রধান ক্রেতা দেশগুলোর শ্রমিক ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো। সেখানকার আমদানিকারকেরাও চাপের মুখে। যেখানে শ্রমিকের নিরাপত্তার মান এই পর্যায়ে, সেখান থেকে তারা তৈরি পোশাক কিনতে এখন সংকোচ বোধ করছে। এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। কিন্তু কোনো দায় নির্ধারণ করে কাউকে দণ্ডিত করা হয়নি। তাই সংশ্লিষ্ট সবাই এই বিচারহীনতার সুযোগটা নিচ্ছে।

ঘটনার কয়েক দিন পর বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর এক যৌথ সাধারণ সভা হয়। সেখানে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করাসহ ক্ষেত্রমতে তাদের সদস্যপদ বাতিলের সিদ্ধান্তও হয় বলে জানা গেছে। তবে সভা শেষে তাদের একজন মুখপাত্র দাবি করেছেন, আলোচিত ঘটনায় দায় প্রথমে ভবনমালিক ও প্রকৌশলীর। তৃতীয় পর্যায়ে সেই দায় পোশাক কারখানার মালিকদের ওপর বর্তায়। আলোচ্য ঘটনাটি অতিরঞ্জিতভাবে প্রচার করে গণমাধ্যম বিদেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলেও সেই মুখপাত্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। 
এরপর আসে পোশাক কারখানার মালিকদের দায়দায়িত্বের অবস্থান নিয়ে। রানা প্লাজার মালিক ও নির্মাণ প্রকৌশলী নিম্নমানের ইমারত তৈরি করে ব্যাপক প্রাণহানির কারণ ঘটিয়েছেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এ ধরনের নিম্নমানের ভবনে জেনে বা না জেনে পোশাক কারখানা স্থাপন ও ঝুঁকি দেখা দেওয়ার পরও সেগুলো পরিচালনা করে এর মালিকেরা কি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের একই কাতারে আসবেন না? তদুপরি শ্রম আইনে কারখানা চলাকালে শ্রমিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব মালিকের। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কীভাবে ঘটনার জন্য কম দায়ী বলে তাঁদের সংগঠন দাবি করতে পারে? আর বিদেশে আমাদের পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারের খোরাক জোগান এ মালিকেরাই; গণমাধ্যম নয়। অবশ্য এসব কলকারখানার অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে যেসব সরকারি সংস্থা রয়েছে, তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদেরও যথেষ্ট দায় রয়েছে।
তথ্যমতে, আমাদের তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা হাজার পাঁচেক। এর একটি বিরাট অংশ কমপ্লায়েন্ট বা মান প্রতিপালনকারী। কমসংখ্যক কারখানাই নন-কমপ্লায়েন্ট। আর সময়ে সময়ে তাদের অতি লোভের বলি হতে হয় দরিদ্র শ্রমিককে। কখনো আগুনে পুড়ে অঙ্গার। আর কখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে বিকৃত হয়ে লাশও অচিহ্নিত থাকে। দাফন হন বেওয়ারিশ হিসেবে। খয়রাতি সাহায্যের মতো কিছু ক্ষতিপূরণ পান বটে। তবে তা দরিদ্র পরিবারগুলোর দারিদ্র্য মোচনে ভূমিকাই রাখে না। আবার সেই ক্ষতিপূরণও কারও কারও ওয়ারিশদের ভাগ্যে জোটে না। এ-জাতীয় দুর্ঘটনার পর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধারকাজে অংশ নেয়। সহায়তায় এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবকেরা। রানা প্লাজার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব ও ধ্বংসের ব্যাপকতায় উদ্ধার অভিযান সময় নিয়েছে।
এখন প্রশ্ন, হতাহত ব্যক্তিদের যৌক্তিক পরিমাণে ক্ষতিপূরণের টাকা দেবে কে? প্রধানমন্ত্রীর অনুভূতি এখানে মর্যাদার দাবি রাখে। রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে এর ব্যবস্থা করা হলেও এটা ভালো কাজে ব্যয় বলেই করদাতা জনগণ মনে করবে। তবে ভবনমালিক ও সংশ্লিষ্ট পোশাক কারখানার মালিকদের এর একটি বড় অংশের শরিকদার হওয়া উচিত। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন ভবনমালিকের জায়গাটি দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা কী করবে, সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় হচ্ছে না। এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হলে জমি অধিগ্রহণ এবং পরবর্তী নির্মাণকাজে প্রচুর টাকা লাগবে। হয়তো তারা ছিটেফোঁটা কিছু দিয়ে শৈবালের মতো শির উঁচু করে এক ফোঁটা শিশির দেওয়ার কথা দিঘিকে মনে রাখতে বলবে।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা একটি সফল খাতের উদ্যোক্তা শ্রেণী হিসেবে সমাজে পরিচিত। তাঁদের প্রচেষ্টায় আজ প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এ খাতে সরাসরি কাজ করছেন। আর তাঁদের সিংহভাগই নারী। তাই কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নে উদ্যোক্তা শ্রেণীর প্রচেষ্টাকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গেই দেখি। তবে এ সাফল্যের পেছনে মূল অবদান রাখছেন শ্রমিকেরাই। তাই তাঁদের প্রতি মালিকেরা সংবেদনশীল হবেন, এটা আশা করা অন্যায্য নয়। এটাও উল্লেখ করা সমীচীন যে তৈরি পোশাকশিল্প পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে আমাদের পরিচিত করতে ভূমিকা রেখেছে। এই শিল্প অন্যান্য অনেক খাতে প্রবৃদ্ধিতেও অবদান রেখেছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পোশাকশিল্পের মালিকদের একটি অংশকে আমরা শ্রমিকদের প্রতি সংবেদনশীল হতে দেখি না। নন-কমপ্লায়েন্ট কারখানাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত কমপ্লায়েন্ট করাতে না পারলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিজিএমইএ সুপারিশ করতে পারে। জানা যায়, ভোটের রাজনীতি এসব প্রতিষ্ঠানকেই প্রভাবিত করছে। তাই কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কার্যত সংঘবদ্ধভাবে তারা পোশাকশিল্পের মালিকের পক্ষাবলম্বন করে। আজতক এ-জাতীয় ঘটনায় কারও শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। শ্রমিকদের বেতনাদি ও স্বার্থের প্রতি তাঁরা আরেকটু সহানুভূতিশীল হতে পারেন। শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার সুযোগ দিতে তাঁদের অনীহা সর্বজনবিদিত। অথচ আইএলও কনভেনশন সেই অধিকার শ্রমিকদের দিয়েছে। আর বাংলাদেশ সেই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র। কিন্তু তা করার পরিবেশই ঘটতে দেন না কারখানার মালিকেরা। দায়িত্বশীল শ্রমিক ইউনিয়ন কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কল্যাণেই ব্যবহূত হয়। চা-শিল্পে দীর্ঘকাল শ্রমিক ইউনিয়ন সক্রিয় থাকলেও বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া তেমন সমস্যা হয়নি। এটা ঠিক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিজেদের সুযোগ-সুবিধাদি নিয়ে দর-কষাকষির চেয়ে ব্যবস্থাপনার দিকেই শ্রমিকনেতারা ঝুঁকে পড়েন। তাঁরা কাজ না করেই বেতন-ভাতাদি নেন। প্রভাব বিস্তার করেন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বদলি ও পদায়নে। কিন্তু একতরফাভাবে এগুলো দেখলে চলবে না। সাম্প্রতিক কালে হল-মার্কসহ ব্যাংক খাতের বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারিগুলোর একটিতেও কোনো শ্রমিকনেতা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন—এমন অভিযোগ নেই। যেসব ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, সেখানে অনুসন্ধানে দেখা যাবে ব্যবস্থাপনার মেরুদণ্ডহীন ও দুর্নীতিপরায়ণ একটি চক্র শ্রমিক ইউনিয়নকে কাজে লাগায়।
পোশাক কারখানার মালিকদের এত বড় মানবিক বিপর্যয়ের পর দ্রুত বড় ধরনের সহায়তা কার্যক্রম নেওয়া আবশ্যক। অন্যের জমি দেখিয়ে আর নিজেদের ভূমিকা অব্যক্ত রেখে তাঁরা সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হননি। শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য যদি ভবনমালিকের জমি নেওয়া হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট পোশাকশিল্পের মালিকদের কাছ থেকেও সমপরিমাণ জমি বা এর মূল্য আদায় করা যৌক্তিক হবে। কেননা, এখানে তাঁদের অপরাধ কিছুমাত্র কম নয়। পোশাক কারখানার মালিকদের উপলব্ধির সময় এসেছে, কিছু মালিকের অপকর্ম তাঁদের সব অর্জন ব্যর্থ করে দেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। ক্রেতা দেশগুলোর দায়িত্বশীল মহল এসব কারখানার শ্রমিকদের ‘শ্রমদাস’ বলে আখ্যায়িত করা আমাদের কারও জন্য গৌরবের বিষয় নয়। আমরা আন্তরিকভাবে এই শিল্পের কোনো ক্ষতি চাই না, বরং চাই এর আরও বিকাশ ও সমৃদ্ধি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.