গল্প- কিশলয়ের জন্মমৃত্যু by গোলাম মুরশিদ

খন যে বসন্ত চলে গেছে টেরই পাইনি। গরমের সুন্দর হাওয়া গা জুড়িয়ে দিচ্ছে। আমার জন্ম মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে, হিমালয়ের গায়ে। তাই ভারি ভালো লাগছে এই উষ্ণ হাওয়া। আমার নাম? আমার নাম কিশলয়। এখনো কিশোর আমি। কিন্তু আমার গড়ন বেশ বাড়ন্ত—অন্তত বন্ধুরা তা-ই বলে। আমার গায়ের রং শ্যামলা-সবুজ। এক বন্ধু তাই আমাকে শ্যাম বলে। সাঁওতালি ছেলেও বলে কেউ কেউ।
প্রথম আমি চোখ মেলে তাকিয়েছিলাম বসন্তের এক ভোরবেলায়। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখছিলাম চারদিকটা। আমার বাসা একটা বড় গাছের মগডালে। আমার চারদিকে আমারই মতো শত শত পাতা। আমি তো গুনতে শিখিনি কিন্তু চারদিক দেখে আমার তা-ই মনে হয়। তোমরা বোধহয় পাতাগুলোকে ভাবো একই চেহারার। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখো, হুবহু একই চেহারার দুটি পাতা পাবে না তুমি। আমার ধারেই থাকে আলো। আলোর মতোই স্বভাবটা হালকা—খিলখিল করে হাসে। আর ডান পাশে বেণু। পর্ণা থাকে একটু সামনে, ওপরের দিকে। ভারি সুন্দর দেখতে সে। ও নিজেও সেটা জানে। কিন্তু তাই বলে কোনো গর্ব নেই ওর। সবাই ওর সঙ্গে মিলতে চায়। মিতালি করতে চায়। রোজ আমি অনেক কথা বলি ওর সঙ্গে। ভালো লাগে ওর সঙ্গে কথা বলতে। ওর গলা খুব মিষ্টি। মাঝেমধ্যে আমাকে গান শোনায়। একা একাও গান করে কখনো কখনো।
ছেলেবেলা থেকে আমরা সবাই বাতাসের সঙ্গে গাইতে শিখেছি, নাচতে শিখেছি। রোজ রোদে স্নান করি। কী যে ভালো লাগে! বিকেল বেলা আলো কমে আসে। আমার মন খারাপ করে তখন। আলো, বেণু, পর্ণা—ওদেরও করে বোধহয়। আমার মনে হয়, আরে, খেলার সময়টা চলে যাচ্ছে। কিন্তু সারা দিন নাচানাচি করে ক্লান্ত হই। তারপর অন্ধকার নামলে কখন যে দুই চোখে ঘুম নামে, জানতেই পাইনে। পরের দিন আবার শুরু হয় খেলার বেলা।
মাঝেমধ্যে বিষ্টি নামে। তার ধারায় স্নান করতে আমার খুব ভালো লাগে। সমস্ত শরীরটা ধুয়ে যায়। সে বিষ্টিও কি এক রকম! কখনো ঝিরঝির করে ঝরতে থাকে। কখনো অঝোর ধারায় যেন রাগ করে ঝরতে থাকে। সমস্ত আকাশ কাঁপিয়ে সে গর্জন করতে থাকে। তার রাগী চোখের দৃষ্টি সমস্ত আকাশটাকে ক্ষণিকের জন্য চোখধাঁধানো আলোতে ঝলসে দেয়। কিন্তু একটু পরই যখন তার মেজাজ ভালো হয়, অমনি সে থেমে যায়। রোদ হেসে ওঠে।
আলোর কথা বলেছি, বেণুর কথা বলেছি, পর্ণার কথাও। কিন্তু এখনো শোনোনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুর কথা। তার নাম ঋষি। কেন যে তার নাম ঋষি আমার জানা নেই। কখনো জিগেস করিনি ওকে। কিন্তু সে অনেক জানে, যেসব কথা আমি কখনো শুনিনি। আমার অন্য সাথিরাও জানে না। এত সব কথা কোথায় শিখেছে সে, সে-ই জানে। কোনো কিছু না জানলে, না বুঝলে, অমনি আমি তাকে জিগেস করি। সে বুঝিয়ে বলে। আশ্চর্য! তার বয়স তো আমার চেয়ে খুব একটা বেশি নয়!
ঋষিই একদিন বলেছিল আমাকে। বলেছিল, আমরা নাকি সবাই একটা গাছের অংশ। গাছটা আছে একটা ছোট গাঁয়ের এক পাশে—একটা বাগানে। গায়ের লোকেরা একে বলে পার্ক। সবুজ ঘাস বিছানো একটা মাঠ আছে সেই বাগানে। চারদিকে অনেক গাছ। নানা ধরনের গাছ। কোনোটার পাতা বড়, কোনোটার ছোট। কারও পাতা বেশ গোল, কারও লম্বাটে। পাতারা সবাই সবুজ হলেও সবার সবুজ কিন্তু ঠিক একরকমের নয়। যে গাছে আমার জন্ম তার পাশেই আছে একটা দেবদারু গাছ। লম্বা লম্বা কোঁকড়ানো পাতা। আমার এখান থেকে দেখা যায়, কিন্তু দূরে আছে একটা মজার গাছ। তার পাতাগুলো খুব সরু আঁশের মতো। বা বলতে পারি, মোটা চুলের মতো। যখন তার গায়ে হাওয়া লাগে, তখন শোঁ শোঁ করে সে গান করে। অন্য গাছের পাতারা চুপ করে শোনে। মাঝেমধ্যে তারা ঝরঝর মড়মড় করে তালি দেয়। তালি দিয়ে তাদের ভালো লাগা জানিয়ে দেয়। পাতার মতোই—অনেক গাছে ফল ধরে, আবার অনেক গাছে ফল ধরে না। যে গাছে আমার জন্ম, সে গাছে কোনো ফল ধরে না। ফল হলে পাখিরা সে ফল খায়। লোকেরা খায়। এমনকি গাছের তলায় যে ফলগুলো পড়ে থাকে—জন্তুরাও সে ফল খায়।
একদিন ঋষি বলেছিল, গাছগুলো মাটির ওপর দাঁড়িয়ে ঠিকই, কিন্তু মাটির তলায় নাকি আছে তাদের শেকড়। লম্বা, মোটা, খুব শক্ত শেকড়। মাটি আঁকড়ে ধরেই নাকি গাছগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। রোজ গাছের ডালে এসে বসে নানা রকমের পাখি। গাছের ডালেই তারা বাসা বাঁধে। তবে সব গাছে নয়। রাতের বেলা ঘুমিয়ে থাকে। কিন্তু রাত পোয়ানোর আগেই তাদের ঘুম ভেঙে যায়।
তার পরই তারা শুরু করে গান গাইতে, শিস দিতে। কী যে মিষ্টি তাদের গান! অনেকে একসঙ্গে গান ধরে। নানা সুরে। সবার গলা একরকমের নয়। আমি সবার গানই শুনতে চাই। কিন্তু ভোরবেলাতে সবাই একসঙ্গে গায় বলে আমি ঠিক ভালো করে শুনতে পাইনে। দুপুরে সবাই ক্লান্ত হয়ে গাছের ডালে ঝিমোতে থাকে। তারই মধ্যে হঠাৎ কেউ উঁচু গলায় গান ধরে, সাথিদের ডাকে। সে গান শুনে আমার খুব ভালো লাগে। ক্লান্তি কেটে যায় আমার।
ঋষি একদিন আমাদের বলেছিল সূর্যের কথা, চাঁদের কথা, তারাদের কথা। রাতের বেলা আকাশে কত তারা মিটমিট করতে থাকে। প্রায় চোখেই পড়ে না। আমি ভাবতাম, তারা অমনই ছোট! কিন্তু আসলে ওগুলো নাকি খুব বড় বড়। ঋষি যে কত কথা জানে!
আমি যে পাতা—এটা ভাবতে খুব ভালো লাগে আমার। ভালো লাগে আশপাশের বন্ধুদের। যে ডালে বাসা বেঁধেছি তাকেও খুব ভালো লাগে। আর আমি সত্যি ভালোবাসি যে গাছে আমার জন্ম, তাকে। সেই তো আমার মা। তার রস খেয়েই নাকি আমরা বেঁচে আছি—ঋষি একদিন বলেছিল। মায়ের দুধের মতো। আমি যে ঘুড়ির মতো আকাশে ভেসে থাকি, হাওয়ার সঙ্গে তালে তালে নাচি—সে কথা ভাবতেই আমার শরীরটা কেমন শিউরে ওঠে। সারা রাত ঠান্ডা থাকার পর রোজ সূর্যের আলোতে স্নান করে আমার শরীর বেশ উষ্ণ হয়। চারদিকের বাতাসে দুলে দুলে নাচি। রাতের বেলায় চাঁদের রুপোলি স্নেহে যেন মায়ের ছোঁয়া পাই।
গরমের সময়টা এবার খুব ভালো কাটল। বেশ গরম পড়েছিল এবার। রাতের বেলাতেও বেশি ঠান্ডা ছিল না। সেই সামান্য উষ্ণ রাত যেন স্বপ্ন নিয়ে আসে সবার মনে। সবার চোখে।
এবার গরমের মধ্যে অনেকেই বেড়াতে এসেছে এই বাগানে। অনেক লোক। ছেলেমেয়েরা। বুড়োবুড়িরা। নানা বয়সের অনেক লোক। অনেকে এসে বসেছে আমাদেরই ছায়ায়। ছায়া দিতে আমার ভারি ভালো লাগে। একদিন পর্ণাকে জিগেস করেছিলাম, সে বলেছিল ছায়া দিতে তারও নাকি খুব ভালো লাগে। ঋষি তো সবই জানে! একদিন সে আমাকে বলেছিল, ছায়া দেওয়া নাকি আমাদের জীবনের একটা লক্ষ্য।
লক্ষ্য? আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম। তারপর ঋষিকে জিগেস করলাম, ‘লক্ষ্য কী?’
ঋষি বলল, ‘লক্ষ্য হলো বেঁচে থাকার একটা কারণ।’ তারপর বুঝিয়ে বলল, ‘আমরা যে জন্মেছি, আমরা যে বেঁচে আছি, এর কারণ কী? বেঁচে থেকে যদি অন্যদের জীবনটাকে একটু সুখ দিতে পারি, অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে পারি, তাহলে বাঁচার একটা মানে হয়। তাই না? যেমন ধরো, গরমে বেশ কাতর হয়ে বুড়োবুড়িরা বাড়ি থেকে বাগানে আসে হাওয়া খেতে, শরীরটা জুড়োতে, একটু বিশ্রাম করতে, তখন আমরা ছায়া দিলে তাদের ভালো লাগে। নয়তো তারা কোথায় বসবে, বলো? বাচ্চারা খেলতে আসে এই পার্কে। তারা কি গরম রোদের মধ্যে খেলবে? আমাদের ছায়ায় খেলে, তাই না? রোজ বাড়িতে খায় সবাই। একদিন একটু ফুর্তি করার জন্য খাবারদাবার নিয়ে বাগানে আসে। বনভোজন করতে। আসে ছেলেমেয়ে নিয়ে। সঙ্গে হয়তো একটা পোষা কুকুরও থাকে। সেই কুকুরের সঙ্গে বাচ্চারা খেলে। চেয়ে দেখো, কেউ এসে মাঠের মধ্যিখানে বসে না। বসে মাঠের ধারে, গাছের তলায়। কারণ, সেখানটাই একটু ঠান্ডা। এভাবে সবার কাজে লাগতে পারলে জীবনের একটা মানে হয়। তাই না?’ একসঙ্গে অনেক কথা বলে ঋষি চুপ করল।
যারা বেড়াতে আসে তাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসি বুড়োবুড়িদের। আর বাচ্চাদের। বুড়োবুড়িরা ঠান্ডা ছায়ায় কেমন চুপচাপ বসে থাকে। বেশি নড়াচড়া করে না। কথা বলে আস্তে আস্তে—যেন ফিসফিস করে!
ছোট ছেলেমেয়েদেরও আমি পছন্দ করি। কিন্তু তারা একটু দুরন্ত হয়। কেউ কেউ আমার মা-গাছকে আঘাত করে। কেউ কেউ গাছের বাঁকলে নিজেদের নাম লেখে। কেউ আবার আমাদেরই ছিঁড়ে নেয়। আমার সাথিদের ছিঁড়তে দেখে আমার কষ্ট হয়, বেচারাদের জন্য কান্না পায়। কিন্তু তবু ছোটদের হইচই করে খেলতে দেখে আমার ভালো লাগে। সেদিন দুটো ছেলেমেয়ে এসেছিল তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে। কী মিষ্টি চেহারা তাদের! মেয়েটার হাসি কী সুন্দর! অনেকটা পর্ণার মতো।
এভাবে দেখতে দেখতে গরমের সময়টা আমার চলে গেল।
হেমন্ত চলে এল। সেই কার্তিকের রাতে কেমন শীত শীত করতে শুরু করল। অঘ্রাণের শুরুতে এক রাতে সত্যি খুব ঠান্ডা লাগল। রাতের বেলা শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছিলাম। মনে হচ্ছিল শরীরটা কে যেন ভিজিয়ে দিচ্ছে। পরের দিন ভোরের আলোতে দেখলাম, আমার গায়ে কী যেন সাদা সাদা লেগে আছে। অন্যদের দিকে চেয়ে দেখলাম, তাদের গাও সাদা সাদা। ঋষিকে জিগেস করলাম, ‘এটা কী, ভাই?’ সে বলল, ‘রাতের বেলা হিম পড়েছিল।’ ‘হিম? হিম কী?’ আমি আবার জিগেস করলাম। সে বুঝিয়ে বলল—বেশি ঠান্ডা পড়লে বাতাসে যে বাষ্প থাকে, তা-ই জমে গিয়ে নাকি হিম পড়ে। ‘বুঝলে, কিশলয়! হিম থেকে বোঝা যাচ্ছে শীতকাল এসে গেছে। দেখবে কী রকম শীত পড়ে। আর চারদিকটাই ঢেকে যাবে সাদা চাদরে, বরফে। মনে হবে যেন কে সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিয়েছে!’—ঋষি বলল, সবজান্তার মতো। সত্যিই তো কত কথা জানে ও!
হিম পড়ার পর কদিন কেটে গেছে। একদিন বিকেলে এদিকে-ওদিকে চেয়ে দেখলাম। কেমন যেন মনে হলো। মনে হলো সমস্ত বাগানটার রং বদলে যাচ্ছে। হয়তো আগে থেকেই রং বদল শুরু হয়েছে। কিন্তু আমার চোখে পড়েনি। অল্প দিন আগেও চারদিকটা কেমন সবুজে ছেয়ে ছিল। মনে হতো যেন সবুজের বান ডেকেছে বাগানে, মাঠে, গাছগুলোর ওধারের দিঘিতে, এমনকি আকাশের কানায় কানায়। সেই সবুজ যেন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। তার বদলে এ কী রঙের খেলা শুরু হলো পাতায় পাতায়!
মনে হলো, সমস্ত পার্কে রঙের আগুন লেগেছে। আমার বন্ধু আলোর দিকে চেয়ে দেখলাম, তাকে চেনা যাচ্ছে না। সবুজের বদলে তার রং হয়েছে গাঢ় হলুদ। বেণুর রং হয়েছে আরও বাহারে! উজ্জ্বল কমলা রং। পর্ণার গায়ে যেন আবির মেখে লালের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমি বললাম, ‘পর্ণা, তোমাকে ভারি ভালো লাগছে—ঠিক কনের মতো। গায়ে লজ্জার লালিমা!’ লালিমা কথাটা একদিন ঋষির মুখে শুনেছিলাম। কনে কথাটাও। সুযোগ পেয়ে শব্দ দুটো কাজে লাগিয়ে দিলাম। খুশি হলো পর্ণা। হেসে বলল, ‘নিজের রংটা দেখেছ? সুন্দর লাগছে তোমাকে।’ তাকিয়ে দেখলাম, কখন যে আমি হলুদ আর কমলা মেশানো একটা অদ্ভুত রঙে নেয়ে উঠেছি খেয়ালই করিনি। ভাবলাম, কোনো এক অজানা জাদুতে সবার রংই পাল্টে গেছে। ঋষি! ঋষির রংটা দেখতে হয়! দেখলাম, তার গায়ে লেগেছে বেগুনির ছাপ। আশ্চর্য! মনে হলো আমরা সবাই মিলে আকাশের রংধনুর রঙে স্নান করে উঠেছি।
আমরা তো সবাই একই মায়ের সন্তান! তা হলে এমন বিচিত্র রং হলো কেন আমাদের? ঋষিকেই জিগেস করলাম। সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল: ‘হ্যাঁ, আমরা একই গাছের পাতা। কিন্তু আমরা সবাই আলাদা। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতাও আলাদা। সূর্যের আলো আমাদের ওপরে পড়েছে এক-একভাবে। ছায়া পড়েছে এক-এক রকম। তা হলে বলো, আমাদের রং এক-এক রকম হবে না কেন!’ এটা তো ভেবে দেখিনি! ঋষি আবার বলল, ‘জানো, এই রঙের মরসুমকে কী বলে? একে বলে হেমন্ত। ঝরে যাওয়ার কাল!’ ঋষির কথা শুনে কী এক অজানা ভয়ে মনটা দুলে উঠল।
এরই মধ্যে একদিন ভারি অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। সেই ছেলেবেলা থেকে হাওয়ার সঙ্গে নেচে নেচে বড় হয়েছি। হাওয়াকে চিরদিন দেখেছি, কী প্রসন্ন। রাগ দেখিনি কখনো। তাকে ডেকেছি মিতা বলে! সেই হাওয়াই একদিন এল কী প্রচণ্ড রাগী চেহারায়! এত দিন তার ঘাড়ে চড়ে খেলেছি। আজ মনে হলো, বোঁটা থেকে সে আমাদের ছিঁড়ে নেবে। আছাড় দিয়ে ছুড়ে ফেলবে। সত্যি সত্যি বাতাসের তোড়ে কেউ কেউ ছিঁড়ে গেল গাছের ডাল থেকে। কেউ বা কোথায় উড়ে গেল তার খবরও জানিনে। একটা ডাল ভেঙে গেল পাশের গাছটার। সত্যি আমরা পাতারা সবাই ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকলাম। আমরা একে অন্যকে ফিসফিস করে জিগেস করলাম, ‘এটা কী হচ্ছে?’
সবজান্তা ঋষি উত্তর দিল। বলল, ‘তোমরা জানো না, কিন্তু হেমন্তের প্রথম দিকে এটা হয়েই থাকে। এ হলো পাতাদের বাসা বদলের সময়। এক অবস্থা থেকে অন্য আরেক অবস্থায় চলে যাওয়ার সময়। লোকেরা একে বলে মরে যাওয়া, এক কথায় মৃত্যু।’
আমি সহজেই ভয় পাই। ঋষিকে জিগেস করলাম, ‘আমরা কি সবাই মরে যাব?’
‘হ্যাঁ, আমরা সবাই—সবাই মরে যাব। সবাই মরে যায়! বড়-ছোট, দুর্বল-সবল—কেউই চিরদিন বেঁচে থাকে না। আমরা মরে যাব।’ আমার মলিন মুখ দেখে ঋষি একটু থেমে গেল। তারপর আবার বলল, ‘দেখো, কিশলয়, আমরা সবাই আসি একটা কাজ নিয়ে। একটা ভূমিকা পালন করতে। সূর্যের আলোতে আমরা বেড়ে উঠি, চাঁদের আলো গায়ে মাখি, হাওয়ার সঙ্গে নাচি, বিষ্টিতে স্নান করি। আমরা নাচতে শিখি, গাইতে শিখি, হাসতে শিখি। কখনো কখনো কাঁদিও। কিন্তু আমাদের কাজ শেষ হলে আমরা চলে যাই। আমরা মরে যাই।’
ঋষির সব কথাই আমি নীরবে মেনে নিয়েছি। কোনো প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু আজ পারলাম না। প্রায় প্রতিবাদের সুরে গলায় জোর এনে বললাম, ‘আমি মরব না!’ তারপর থেমে আবার বললাম, ‘ঋষি, তুমি কি মরবে?’
ঋষির মুখের একটি পেশিও নড়ে উঠল না। অবলীলায় বলল, ‘হ্যাঁ, আমি মরব তো! আমার যখন সময় হবে, তখন আমি মরে যাব।’
‘সময়! কখন সময় হবে?’—আমি জিগেস করলাম।
ঋষি বলল, ‘সেটা কেউই ঠিক করে জানে না।’
আমি ভাবলাম, ঋষি নিশ্চয় ভুল বলেছে। এই যে আমি, বেঁচে আছি, ভাবছি, ভালোবাসছি, কল্পনা করছি—এই আমি কি মরতে পারি? কক্ষনো না!
কিন্তু দিন যায়। আমি লক্ষ করি, আরও পাতা ঝরে পড়ছে। মা-গাছের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। তা হলে, ঋষিই কি ঠিক বলেছে? তা হলে এদের কি সময় হয়ে গেছে?
আমি লক্ষ করলাম, কোনো কোনো পাতা ঝরে পড়ার আগে প্রাণপণ গাছটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। ছিঁড়ে নিতে চাওয়া হাওয়াকে ফাঁকি দিতে চায়। আবার কেউ কেউ হাওয়ায় চড়ে মৃত্যুর রথ এলে নিজের বাঁধনটাকে ছেড়ে দেয়। তারপর ঝরে পড়ে নীরবে, শান্তভাবে।
দিন থেমে থাকে না। নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছি। তারই মধ্যে একদিন আমি চারদিকটা চেয়ে দেখি। দেখলাম, গাছের ডালগুলো প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। একদিন ঋষিকে বললাম, ‘ঋষি, তুমিই বোধহয় ঠিক। হয়তো মরতেই হবে। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে। আমি জানিনে নিচে, গভীরে কী আছে। মনে হয়, সেখানে আছে এক রাশ জমাটবাঁধা অন্ধকার।’
শান্ত কণ্ঠে ঋষি বলল, ‘দেখো, কিশলয়, আমরা যা জানি না, তাকে আমরা সবাই ভয় পাই।’ তার কথা শুনে একটুখানি ভরসা পেলাম। ‘কিন্তু বসন্ত গিয়ে যখন গরমের সময় এল, তখন তো আমরা ভয় পাইনি! গরমের সময় গিয়ে যখন হেমন্ত এল তখনো তো ভয় পাইনি। এই পরিবর্তনই স্বাভাবিক। তা হলে মৃত্যুর ঋতু দেখে ভয় পাব কেন?’
‘আমাদের মা-গাছ? সেও কি মরে যাবে?’
‘হ্যাঁ, একদিন সেও মরে যাবে। কিন্তু সে কথা থাক। মনে রেখো, এ গাছের থেকেও শক্তিশালী একটা জিনিস আছে। সে হলো জীবন। জীবনের কোনো শেষ নেই। আমরা সেই অন্তহীন জীবনেরই অংশ।’—ঋষি বুঝিয়ে বলল।
ভালো না লাগলেও ঋষির কথা মেনে নিলাম। কিন্তু সংশয় কাটে না। অজানার আশঙ্কায় মনটা কেমন করে ওঠে। ঋষিকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা ঋষি, মরে যাওয়ার পর কোথায় যাব আমরা সবাই?’
‘সেটা তো কেউ ঠিক জানে না! সেটা সত্যি একটা বিরাট রহস্য।’—ঋষি বলল।
‘আমরা কি আবার ফিরে আসব? আগামী বসন্তে?’
‘না, আমরা বোধহয় ফিরব না। কিন্তু জীবন থেমে যাবে না। জীবন আবার ফিরে আসবে।’
আমার মন তবু তৃপ্তি পায় না, সান্ত্বনা পাই না। আবার বলি, ‘তাহলে এই এলাম, এই যে বড় হলাম, হাসিকান্নায় এত দিন বেঁচে থাকলাম, এর মানে কী?’ একটু থেমে আবার ভেবে বললাম, ‘যদি ঝরেই যাব, যদি বিদায় নিতেই হবে, তাহলে এসেছিলাম কেন?’
কোনো আবেগ দেখাল না ঋষি। বলল, ‘এটাই জীবন। এই যে সূর্যের আলোতে বেঁচে থাকলাম, এই যে চাঁদের আলোর স্নেহশীতল স্পর্শ পেলাম, এই তো জীবন! একসঙ্গে আনন্দের সময় কাটিয়েছি আমরা। ছায়া দিয়েছি। বুড়োবুড়ি আর শিশুদের দেখেছি—সেবা করেছি। হেমন্তে রঙের খেলা দেখেছি। দেখেছি ঋতুবদলের পালা। এই কি যথেষ্ট নয়? এই তো জীবন!’
সেদিন গোধূলি আলোয় হাওয়ার রথ এল। ঋষি তাতে চেপে বসল। মনে হলো, পড়ে যেতে যেতেও সে শান্ত হাসিতে উদ্ভাসিত। দূরে যেতে যেতে আমাকে বলল, ‘কিশলয়, এখনকার মতো বিদায়, ভাই!’
ডালটায় আর কেউ বাকি নেই। শুধু আমি। একা। কোথায় গেল আলো, বেণু, সুন্দরী পর্ণা! খেয়াল করিনি তো! কোথায় গেল আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু—ঋষি! আমি বেঁচে আছি। কিন্তু নিঃসঙ্গ। কিছু করার নেই। আমার ভূমিকা শেষ। সত্যি কি বেঁচে থাকতে চাই আমি?
পরের দিন এ মরসুমের প্রথম বরফ পড়ল। পেঁজা তুলোর মতো! সুন্দর! কোনো ভার নেই তার কিন্তু ভারি ঠান্ডা। সেই সঙ্গে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। সূর্যের আলো দেখা গেল না প্রায় সারা দিন। দিনটা কেটে গেল দেখতে দেখতেই। মনে হলো, আমার যেটুকু রং বাকি ছিল, তাও যেন হারিয়ে গেল। ডালটাকে ধরে রাখার শক্তি আমার যেন লোপ পাচ্ছে। তারই মধ্যে বরফ পড়ছে নিঃশব্দে। রাতের নীরব অন্ধকারে অজানা কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমার ওপর বরফ জমে উঠছে ধীরে ধীরে।
ভোরবেলাতে একটা হাওয়া এল। সেই সঙ্গে যেন এল অজানার আহ্বান। আমি ডালটাকে ছেড়ে দিলাম। একটুও লাগল না আমার। আমি যেন ভেসে চলেছি নিচের দিকে, খুব ধীরে। তারপর মাটিতে পড়ে প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম পুরো গাছটাকে। কী বিশাল! কী দৃঢ়। নিশ্চিত জানি, আমি বিদায় নিলেও এ গাছ বেঁচে থাকবে বহুকাল! জানি আমিও জীবনের অংশ ছিলাম। ভাবতেও আমার গর্ব হচ্ছে—আমি জীবনের অংশ ছিলাম। জীবনের ধন কিছুই বিফলে যায়নি। কিছুই বিফলে যাবে না। জীবনের প্রবাহ চলতে থাকবে অনাগতকাল ধরে।
আমি পড়লাম, তুলোর মতো নরম এক তাল বরফের ওপর। মনে হলো, সে বরফ নিষ্প্রাণ শীতল নয়। তার ভেতর প্রাণের উষ্ণতা টের পেলাম যেন। যেভাবে পড়ে থাকলাম, তাকে খুব আরামের মনে হলো। এর আগে কখনো এমনটা মনে হয়নি।
আমি বড্ড ক্লান্ত। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে আমার।
কিশলয় সত্যি ঘুমিয়ে পড়ল।
কিশলয় জানত না, শীতের পরে আবার বসন্ত আসবে। জানত না, চিরদিন বরফ থাকবে না। বরফ গলে গিয়ে জল হবে। সে জানত না, সেই জলে মিশে তার শুকনো দেহটা মা-গাছের শেকড়ে গিয়ে আবার গাছে মিশে যাবে। জানত না, তার দেহটা বিফলে যাবে না। গাছটা আরও জোরালো হয়ে উঠবে। যা একদমই জানত না কিশলয়, সে হলো: গাছ আর মাটিতে মিলে এরই মধ্যে ঠিক করে ফেলেছে নতুন ফাল্গুনে আরেক রাশ পাতা আসবে গাছে।
=========================
গল্প- মাকড়সা  দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র


দৈনিক প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ লিও বাস্কালিয়ার রচনা অবলম্বনে গোলাম মুরশিদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.