কথায় কথায় টিভি চ্যানেল বন্ধ নয় by সুপন রায়

টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করার ঘটনায় গত ১০ মে অগ্রজ সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ও মনজুরুল আহসান বুলবুলের দুটি লেখা পড়লাম প্রথম আলোয়। লেখা দুটি সময়োপযোগী, তথ্যবহুল এবং প্রাসঙ্গিক। এ জন্য দুজনকে জানাই অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই প্রথম আলো কর্তৃপক্ষেকে।
দুজনের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি তাৎপর্য। তার পরও আরও কিছু বলার তাগিদ থেকে এ লেখা।
বাংলাদেশে অনেক কিছুরই শুরুটা চমৎকার হয়। কিন্তু তারপর সবকিছু কেমন যেন হয়ে যায়। যেমন ‘একুশে’ টেলিভিশন। স্বপ্নের মতো শুরু। কিন্তু এখন? সব স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার। ভেঙে গেল সব আয়োজন। বলা যেতে পারে, ভেঙে দেওয়া হলো।
স্বপ্নের সেই টেলিভিশন গড়ার মূল কারিগর যাঁরা (প্রয়াত আবু সাঈদ মাহমুদ, ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং, ফরহাদ মাহমুদ) ‘করতে করতে শেখো’ এ ধরনের প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁরা। বিনিয়োগ, সম্প্রচারের উৎকর্ষ যন্ত্রপাতি, বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ, দক্ষ জনবল সব আয়োজনই করেছিলেন। শিক্ষা, রুচি, অর্থের চমৎকার সম্মিলন হয়েছিল একুশে টেলিভিশনে। যার ফলাফলও আমরা পেয়েছিলাম দ্রুত। স্বপ্নের সেই টিভি এখন আমাদের কাছে ইতিহাস। ‘একুশে’ টেলিভিশনের দেখানো পথ অনুকরণ করার চেষ্টা করছে অধিকাংশ টিভি চ্যানেল। সংবাদ কাঠামো, উপস্থাপনশৈলী, অনুষ্ঠানের ধরন অনেক কিছুই অনুসরণ করছে অন্য চ্যানেলগুলো। কিন্তু বিনিয়োগ, সম্প্রচার যন্ত্রপাতি বা অবকাঠামো—টেলিভিশনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এদিকগুলো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ চ্যানেল।
একুশে টেলিভিশনের ‘টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি’ খুঁজে পেয়েছিলেন আদালত। সেই ত্রুটির অজুহাতে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় টেলিভিশনটি বন্ধ করে দিয়েছিল জোট সরকার। তারপর টেন্ডার-প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে মন্ত্রী, সাংসদদের নামে দেওয়া হলো একের পর এক লাইসেন্স। জোট সরকারের পথ অনুসরণ করে মহাজোট সরকারও যোগ্য ও পেশাদার বিনিয়োগকারীর বদলে দলীয় অনুসারীদের নামে দিল ১০টিরও বেশি লাইসেন্স। তার কিছুদিন পরই পুনঃ অনাপত্তিপত্র আবেদনের অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হলো ‘যমুনা টিভি’র পরীক্ষামূলক সম্প্রচার। মালিকানা একজনের, যন্ত্রপাতি আরেকজনের, এই অজুহাতে বন্ধ করে দেওয়া হলো ‘চ্যানেল ওয়ান’। অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল দুই টেলিভিশনে কর্মরত এক হাজার কর্মী। প্রতিহিংসা, ব্যক্তিগত বিরোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব থাকতে পারে টেলিভিশনের মালিকের সঙ্গে। কিন্তু আমরা যারা সংবাদকর্মী, তারা সবাই নিবেদিতপ্রাণ, পেশাদার। অনিয়ম যদি হয়ে থাকে তাহলে শাস্তি কিংবা আর্থিক দণ্ড দিয়েও প্রতিকার করার সুযোগ থাকে। বন্ধ করতে হবে কেন? অতীতে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, মোবাইল ফোন কোম্পানিতে নানা অনিয়ম প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান কি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? তাহলে টেলিভিশন বন্ধ করতে হবে কেন? করতে হবে, কারণ প্রতিহিংসা। কারণ, সমালোচনা সহ্য না করার মানসিকতা। ফলে সেই প্রতিহিংসার আগুনের মধ্যে পড়ে পুড়ে মরছে আমাদের অনেক সহকর্মী।
জোট সরকার মনে করেছিল, দলীয় বিবেচনায় লাইসেন্স দিলে প্রয়োজনের সময় সেটি কাজে দেবে। কিন্তু তাদের সেই ধারণা গত নির্বাচনের সময় ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এখন অনেক টিভি চ্যানেল। একটি পক্ষপাত করলে দর্শক মুখ ফিরিয়ে অন্যটিতে ঝুঁকবে। দর্শক হারানো মানে উপার্জন হারানো। কারণ, প্রতিটি চ্যানেলকে প্রথমত দর্শক, দ্বিতীয়ত বাজারের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। চ্যানেলের মালিক যে মতাদর্শেরই হন না কেন, বাস্তবে তাঁকে একধরনের ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে হয়। তা না হলে নানামুখী ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এখন বাজারই চ্যানেলের মূল নিয়ন্ত্রক। সেই চাপ উপেক্ষা করা কঠিন। তাই আজ যে চ্যানেলগুলোকে দলীয় বিবেচনায় অনুমোদন দেওয়া হলো, কিছুদিন পরই প্রমাণিত হবে, বিবেচনা কতখানি ভুল ছিল। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
আমরা সবাই জানি, ভালো মানের পেশাদার টেলিভিশন গড়তে হলে বড় বিনিয়োগ দরকার। যমুনা টিভি সে ধরণের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ করার দিক হলো, যারাই বড় বিনিয়োগে টিভি প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছে, বাস্তবে তাদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে পড়তে হয়েছে। একুশে টিভিকে পড়তে হয়েছিল, যমুনা টিভিকে পড়তে হলো। কারণ, একটাই। অসম প্রতিযোগিতা। বাজার দখল করে রাখার ইচ্ছা।
যমুনা টিভি বা অন্য নতুন টিভি চ্যানেল আসুক তা যেকোনো পেশাদার সংবাদকর্মীর চাওয়া হওয়া উচিত। কিন্তু পুরোনো ও নতুন মালিকেরা তা চান না। কেন চান না, ওই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও আশা করি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
কথায় কথায় টিভি বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারটি ঘটছে, মূলত এর আইনি সুরক্ষা না থাকার কারণে। সে কারণে বন্ধ হয়েছে একুশে টিভি, সিএসবি, যমুনা টিভি এবং সবশেষে চ্যানেল ওয়ান। একসময় এমন করে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হতো। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন সেই অশুভ থাবা থেকে সংবাদপত্র শিল্পকে রক্ষা করেছেন। সময় এসেছে, টেলিভিশনের জন্য সে রকম একটি আইনি সুরক্ষার।
রাজনীতিকদের মতো আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকেরা দুই ধারায় বিভক্ত বলেই একেক সময় একেক সরকার আমাদের মতো পেশাদার সংবাদকর্মীর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ পায়। সংবাদকর্মীরা পেশার প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ঐক্যবদ্ধ থাকলে এমনটি ঘটানোর সাহস কোনো সরকারই পেত না। সময় এসেছে ব্যাপারটি নিয়ে সোচ্চার হওয়ার। গভীরভাবে ভেবে দেখার।
সুপন রায়: সংবাদকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.