জ্বালানী সম্পদ -গভীর সমুদ্র কি গ্যাসের নতুন দিগন্ত হতে পারে by বদরূল ইমাম

বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা এ প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য। এ আলোচনা সম্প্রতি পাওয়া কিছু নতুন ভূতাত্ত্বিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। এ তথ্যগুলো ভারতীয় সমুদ্র অঞ্চলে পরিচালিত অনুসন্ধান কার্যক্রমের সূত্রে পাওয়া গেছে। এর কিছু অংশ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সভায় আলোচিত ও প্রকাশিত এবং কিছু অংশ অপ্রকাশিত ও গোপনীয় বলে বিবেচিত। পাঠকের সুবিধার্থে আলোচনায় ভূতাত্ত্বিক তথ্যের জটিল অংশগুলোতে সহজ ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও এতে বক্তব্য অতি সহজীকরণের প্রভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
বিশ্বে অগভীর সমুদ্র অঞ্চলে বহু বছর ধরেই তেল-গ্যাস কার্যক্রম চলে আসছে, কিন্তু গভীর সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে নতুন। তবুও গভীর সমুদ্রবক্ষ পৃথিবীর অনেক দেশে তেল-গ্যাস ভাণ্ডারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ তার গভীর সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলের ওপর ভূতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজনের তুলনায় নেই বললেই চলে। এমতাবস্থায় এর গ্যাস সম্ভাবনার ওপর বাস্তবধর্মী যুক্তি উপস্থাপন করা অসম্ভব না হলেও কঠিন। তবে এর সংলগ্ন ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তথ্য বিশ্লেষণ করে সম্ভাবনার একটি চিত্র দাঁড় করা যেতে পারে। এর আগে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার উভয়েই বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্র অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করে এবং বিগত বছরগুলোতে উভয়েই গ্যাসের বিরাট মজুদ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলও কি গ্যাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে?
বঙ্গোপসাগর ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কা—এই চারটি দেশের উপকূল ছাড়িয়ে বিশাল এলাকাব্যাপী বিস্তৃত এবং এ সাগরের গভীরতা প্রায় এক শ মিটার থেকে চার হাজার মিটার। তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে সাধারণত সমুদ্রে পানির গভীরতা ৪০০ মিটারের কম হলে তাকে অগভীর সমুদ্র এবং এর বেশি হলে তা গভীর সমুদ্র হিসেবে গণ্য করা হয়। গভীর সমুদ্রে সাধারণত পানির গভীরতা ২০০০ মিটার পর্যন্ত এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হয়ে থাকে। গভীর সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমে ভারত ও পূর্বে মিয়ানমার উভয় দেশেরই সীমানা চিহ্নিতকরণ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে এবং বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশ দাবি করে, এ দুটি দেশই সমুদ্রবক্ষে এর সীমানার ভেতর অনুসন্ধানকাজ চালাচ্ছে।
গভীর সমুদ্রে ভারত: বাংলাদেশের গভীর সমুদ্র অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভারতের গভীর সমুদ্র ব্লক ডি-৬, আর এখানেই পাওয়া গেছে বিরাট গ্যাসের মজুদ, যা কিনা ভারতের অন্য যেকোনো এলাকার গ্যাস মজুদের চেয়ে বেশি। উল্লেখ্য, ভূখণ্ডে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের তুলনায় সমুদ্রবক্ষে অনুসন্ধান কারিগরিভাবে অনেক জটিল ও আর্থিকভাবে বহুগুণে ব্যয়বহুল এবং গভীর সমুদ্রে তা আরও বেশি। গভীর সমুদ্রে এই ব্লকটিতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে ভারতের দেশীয় কোম্পানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। শিল্পপতি ধীরুভাই প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি ভারত তথা বিশ্বে অন্যতম বৃহত্ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত হয়েছে। কোম্পানির বর্তমান কর্ণধার তাঁর পুত্র মুখেশ আদভানির সময়ে গভীর সমুদ্র ব্লক ডি-৬-এ একের পর এক আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো (নাম দেওয়া হয় ধীরুভাই-১, ধীরুভাই-৩ ইত্যাদি) ভারতের গ্যাসচিত্রে আমূল পরিবর্তন বহন করে আনে। এ ছাড়া নিকটবর্তী একাধিক সমুদ্র ব্লকেও আশানুরূপ গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি কানাডার ভ্যানকুভার শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক গ্যাস সম্মেলনে রিলায়েন্স কোম্পানির ভূবিজ্ঞানীরা ভারতের গভীর সমুদ্রে বিশাল গ্যাস মজুদ সৃষ্টির এক ভূতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। তাঁদের মতে, এটি সনাতনী প্রথায় সৃষ্ট থারমোজেনিক (thermogenic) প্রাকৃতিক গ্যাস নয় বরং এটি অসনাতনী বায়োজেনিক (biogenic) প্রাকৃতিক গ্যাস। গুণে ও মানে একই প্রকারের হলেও এরা উত্পত্তিগতভাবে ভিন্ন। সনাতনী থারমোজেনিক গ্যাস সৃষ্টি হয় ভূগর্ভে অনেক গভীরতায় শিলাস্তরের জৈবিক পদার্থগুলো উচ্চ তাপের প্রভাবে গ্যাসে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে পাওয়া বেশির ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাসই থারমোজেনিক প্রকৃতির। অপরপক্ষে বায়োজেনিক গ্যাস সৃষ্টি হতে তাপ দরকার হয় না, বরং এ ক্ষেত্রে অতি অল্প গভীরতায় এক ধরনের জীবাণু দ্বারা জৈবিক পদার্থ গ্যাসে পরিণত হয়। বাংলাদেশে তেল-গ্যাসের উত্স নিয়ে যে ভূবিজ্ঞানীরা কাজ করে থাকেন, তাঁদের কাছে এ দেশের ভূগর্ভে পর্যাপ্ত তাপ (ভূবিজ্ঞানের ভাষায় thermal maturity বা তাপজনিত পরিপক্বতা) না থাকাটা পর্যাপ্ত গ্যাস সৃষ্টি হওয়ার পথে একটি বাধা। আর এ কারণেই গভীর সমুদ্রে থারমোজেনিক গ্যাসের পরিবর্তে বায়োজেনিক গ্যাসের (যা তৈরি হতে তাপ লাগে না) আবিষ্কার একটি আশাপ্রদ লক্ষণ।
ভারতীয় ভূবিজ্ঞানীরা এই গ্যাস সৃষ্টির পর তা মজুদ হওয়ার পদ্ধতিরও একটি নতুনতর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, এই গ্যাস তৈরি হয়ে তা সরাসরি এসে মজুদ হয়নি বরং তা প্রথমে সাগরতলে গ্যাস হাইড্রেট (gas hydrate—গ্যাস ও পানিমিশ্রিত বরফসম পদার্থ) হিসেবে অবস্থান করেছে ও পরবর্তীকালে অল্প তাপে গ্যাস হাইড্রেট অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে ‘বরফ’ থেকে গ্যাস আলাদা হয়ে সুবিধাজনক স্থানে জমা হয়েছে। এ ব্যাখ্যাটি পুরোপুরি অসনাতনী অর্থাত্ গ্যাসবিজ্ঞানের প্রচলিত ধারার বাইরে। তবে এটি একাধিক কারণে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। প্রথমত, গ্যাস সৃষ্টি হয়ে তা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হারিয়ে যেতে পারে, কিন্তু বরফসম গ্যাস হাইড্রেট গ্যাসকে সমুদ্রতলে আটকে রাখে। দ্বিতীয়ত, গ্যাস হাইড্রেট সম্প্রতিকালে ভূবিজ্ঞানীদের মধ্যে নতুন আগ্রহের জন্ম দিয়েছে এ কারণে যে বরফসম এ পদার্থটি বিশ্বের বহু সমুদ্রের গভীরে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এর সঙ্গে গ্যাসবিজ্ঞানের নানা সম্পর্ক ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে চলেছে। সুতরাং ভারতীয় গভীর সমুদ্র ব্লকে প্রাপ্ত গ্যাসের মজুদ নিয়ে রিলায়েন্স কোম্পানির ভূবিজ্ঞানীদের দেওয়া সূত্র যদি ঠিক হয়ে থাকে, তবে সে ধরনের প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবক্ষে থাকার সম্ভাবনার কারণে এটিকেও গ্যাস সম্ভাবনাময় মোক্ষম এলাকা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
অন্যরা কী বলে: অনেকটা একই ধারণা পোষণ করেন ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানির ভূবিজ্ঞানী জনাথন এভান। এই কোম্পানি কিছুদিন আগে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধান করার আগ্রহ প্রকাশ করে এ দেশে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ সফরে পাঠায় কোম্পানির দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক এই ভূবিজ্ঞানীকে। তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক সাক্ষাতে জানান, তাঁদের ধারণা, বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্র অঞ্চলে নতুন অসনাতনী প্রকৃতির বায়োজেনিক গ্যাস পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি ইতিমধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে মিসরের গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান চালিয়ে আশানুরূপ বায়োজেনিক গ্যাসের সন্ধান পায়। তারা মনে করে, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে সে রকম পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ব্লকগুলোর সীমানা নিয়ে বিরাজমান আন্তর্দেশীয় বিরোধের কারণে কেবল ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানিই নয়, অনেক বড় কোম্পানি এ মুহূর্তে এখানে আসতে আগ্রহ হারিয়েছে। যা-ই হোক, একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্র অঞ্চলে গ্যাস সম্ভাবনার ব্যাখ্যায় ব্রিটিশ ভূবিজ্ঞানীর ধারণার সঙ্গে ভারতীয় ভূবিজ্ঞানীদের মতের মিল রয়েছে।
কেবল তা-ই নয়, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পূর্ব দিকে মিয়ানমার সমুদ্র অঞ্চলে সম্প্রতি যে বিরাট গ্যাসের মজুদ (সুউ, সুউফিউ ও মিয়া গ্যাসক্ষেত্রগুলো) পাওয়া গেছে, তার ভূবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় একই ধরনের সূত্রের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাত্ বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মাত্র ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে মিয়ানমার সমুদ্রে আবিষ্কৃত গ্যাসগুলোও বায়োজেনিক প্রাকৃতিক গ্যাস বলে জানা গেছে। এই গ্যাসের মজুদ এতটাই উল্লেখযোগ্য যে এটা কিনতে ভারত ও চীন উভয়েই তীব্র প্রতিযোগিতায় নামে এবং শেষ পর্যন্ত চীনেরই জয় হয়।
উপসংহার: বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দুটি প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার নিজ নিজ সমুদ্রবক্ষে (যদিও তারা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানায় অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে) অনেক বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্রের আবিষ্কার করে গ্যাসসম্পদের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পেরেছে। ফলে এ সাগর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে নতুনভাবে আকৃষ্ট করেছে। বিজ্ঞানীরা এখানে গ্যাসসম্পদের উত্স নিয়ে নতুন সূত্র ব্যাখ্যা করে এর ব্যাপ্তি ও সম্ভাবনার নানা বিষয় নিয়ে মত দিচ্ছেন। গ্যাসবিজ্ঞানের প্রচলিত সূত্রে নয়, বরং স্বল্প গভীরতায় তাপের প্রভাব ছাড়াই জীবাণুর দ্বারা সৃষ্ট বায়োজেনিক গ্যাস শীতল সাগরতলে ‘বরফসম’ গ্যাস হাইড্রেটে পরিণত হওয়া এবং পরে ‘বরফ’ গলে গ্যাস বের হয়ে সুবিধাজনক স্থানে মজুদ আকারে জমা হওয়া—এ সবই গ্যাস-ভূবিজ্ঞানে নতুনতর অসনাতনী ব্যাখ্যা। এ সূত্র যথার্থ প্রমাণিত হলে তা গ্যাসবিজ্ঞানে যেমন, তেমনি গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবক্ষ ভূতাত্ত্বিকভাবে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞাত এলাকা। এই অঞ্চল গ্যাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে কি না, এটি বাস্তবিক পক্ষে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, যার উত্তর এখন পর্যন্ত কারও জানা নেই। তবে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাফল্য বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রকে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এ সম্ভাবনার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করতে হলে প্রয়োজন ব্যাপক আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান। বহুসংখ্যক অজ্ঞাত বৈজ্ঞানিক উপাদানকে ব্যাপক অনুসন্ধান-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথমে সত্যায়িত করা এবং এর ওপর ভিত্তি করে কার্যপন্থা নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করাই উপরিউক্ত প্রশ্নের উত্তরের সন্ধান পাওয়ার একমাত্র পথ।
বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা

No comments

Powered by Blogger.