শতবর্ষী ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি by আঞ্জুমান আরা

বই মনের দরজা-জানালা খুলে দেয়। একনিমেষেই নিয়ে যায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে। সাদা কাগজের রঙিন মলাটে সাঁটা বর্ণগুলো মানুষকে জানিয়ে দেয় তার অনেক অজানা তথ্য। নাটোরের কাপুড়িয়াপট্টিতে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে আসা একজন পাঠক উপল দেব বইপড়া নিয়ে এ কথাগুলো বলেন।
বই উপলের নিত্যসঙ্গী। পড়ার অভ্যাস থাকলেও সব বই তো আর কিনে পড়া সম্ভব নয়, তাই লাইব্রেরির সদস্য হয়েছেন। শুধু বিভিন্ন ধরনের বই নয়, প্রতিদিন পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ও চাকরির খবরাখবর পড়ার জন্য উপলের মতো অনেকেই আসে লাইব্রেরিতে। কারণ, এ লাইব্রেরির ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ। প্রায় ১৪ হাজার বই রয়েছে। এছাড়া ১২টি দৈনিক, চারটি সাপ্তাহিকসহ লাইব্রেরিতে প্রতিদিন সংযোজিত হচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরের প্রকাশনা।
পাঠাগারের নিয়মিত পাঠক আতিকুল হক বলেন, ‘চাকরির ব্যস্ততা আর বাড়িতে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের একঘেয়েমির মধ্যে এখানে আসি কিছুটা সময় নিজের করে পাওয়ার জন্য।’
আকাশসংস্কৃতির কারণে বই যখন পাঠক হারাচ্ছে, তখন পাঠকনন্দিত এই লাইব্রেরির পাঠচক্রের ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা যায়। ইতিমধ্যে এ লাইব্রেরি তার পথচলায় শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। এই পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে লাইব্রেরিটি নাটোরের গৌরবময় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আর হবেই বা না কেন, লাইব্রেরির পথপরিক্রমায় যে অনেক বিখ্যাত মানুষ জড়িয়ে আছেন। ভাবা যায়, এই লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠার মহোত্তম পরামর্শক ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাটোরের মাহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায় ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও সুসাহিত্যিক। ‘সন্ধ্যাতারা’র কবি নামে খ্যাত জগদিন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে কবিগুরুর সুসম্পর্ক ছিল। মহারাজার আমন্ত্রণে নাটোরে বিশ্বকবির আগমন ঘটেছে বারবার। ১৮৯৭ সালে নাটোরে এসে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যানুরাগী মহারাজাকে পরামর্শ দেন একটি লাইব্রেরি করার জন্য। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ১৯০১ সালে জগদিন্দ্রনাথ রায় প্রতিষ্ঠা করেন ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি। শহরের লালবাজারে মহারাজা কর্তৃক প্রদত্ত কিছু বই, একটি ঘড়ি আর এককালীন সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি।
মহারাজা লাইব্রেরির গ্রন্থ নির্বাচনের দায়িত্ব দেন তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্র ও ভারতবর্ষ প্রত্রিকার সম্পাদক রায়বাহাদুর জলধর সেনকে। লাইব্রেরির সংগ্রহশালায় সংযোজিত হয় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত বিদ্যাসাগর রচনাবলী, নিয়মিত পত্রপত্রিকা মানসী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ ইত্যাদি।
১৯৩০ সালে লালবাজার থেকে ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরি স্থানান্তরিত হয় কাপুড়িয়াপট্টি এলাকায়। একটি চারচালা টিনের ঘরে নতুন আঙ্গিকে শুরু হয় এর পথ চলা। এ সময় কিছু জ্ঞানানুরাগী মানুষের সান্নিধ্যে লাইব্রেরিতে সমৃদ্ধি আসে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. নলিনী কান্ত সাহা, নিরঞ্জন কুমার সাহা, সুবীর চন্দ্র রায়, শিক্ষাবিদ শীতেন্দ্র মোহন প্রমুখ। এ সময় লাইব্রেরিতে সংযোজিত হয় দেশ-বিদেশের নানা গ্রন্থসহ বাংলার ইতিহাস ও বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী। ওই সময় প্রতি চান্দ্রমাসের পূর্ণিমা তিথিতে ‘পূর্ণিমা সম্মিলনী’ নামের সাহিত্য আসর চালু হয়। আয়োজন করা হতো বার্ষিক সাহিত্য সম্মেলনেরও। এসব সম্মেলনে বিভিন্ন সময় অতিথি হয়ে এসেছেন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা যুগান্তর-এর সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, আনন্দবাজার-এর সম্পাদক চপলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ গুণীজন।
লাইব্রেরির ছন্দপতন ঘটে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর থেকে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশ ত্যাগে শূন্যতা নেমে আসে। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে বইপুস্তক, আসবাব লুটপাট ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে লাইব্রেরিটি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পরে। তবে সে সময় লাইব্রেরিতে সংগীতচর্চা কার্যক্রম চালু হওয়ার ফলে এটি তখন ভিক্টোরিয়া ক্লাব হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ১৯৮০ সালে তত্কালীন মহকুমা প্রশাসক এ এইচ এস সাদিকুল হক লাইব্রেরির দৈন্যদশা উত্তরণে এগিয়ে আসেন। এ সময় গঠণতন্ত্র প্রণয়নসহ প্রশাসনিক সহযোগিতায় নতুন আঙ্গিকে প্রাণ ফিরে পায় লাইব্রেরিটি। ১৯৮৬ সালে গঠণতন্ত্র অনুযায়ী পদাধিকারবলে লাইব্রেরির সভাপতি হন নাটোরের জেলা প্রশাসক জালাল উদ্দিন আহম্মেদ। তাঁর উদ্যোগে লাইব্রেরির আমূল পরিবর্তন ঘটে। সেই টিনের চারচালা লাইব্রেরি পরিণত হয় দ্বিতল ভবনে।
নাটোর ভিক্টোরিয়া লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক রাশিদুজ্জামান সাদী বলেন, ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন ও লাইব্রেরির যৌথ উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি মাসে সপ্তাহব্যাপী বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক দেয়ালিকা বনলতা। এ ছাড়া জাতীয় দিবস, সাহিত্য আসর, বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের জন্ম-মৃত্যু দিবস পালনসহ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
লাইব্রেরির নিয়মিত সদস্য পাঠক প্রায় দেড় হাজার। আর প্রতিদিন গড় পাঠক ১৫০ জন। শনিবার ছাড়া বিকেল চারটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সর্বস্তরের পাঠকের জন্য এটি খোলা থাকে। তবে শতবর্ষী এই লাইব্রেরিতে পাঠকের জন্য ইন্টারনেটব্যবস্থা এখনো চালু করা যায়নি। এ ছাড়া রয়েছে আসবাবের অপর্যাপ্ততা। তার পরও বটবৃক্ষের ছায়াস্বরূপ শতবর্ষী এই লাইব্রেরি সুস্থ ও সুন্দর জীবনবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি সচেতন সমাজ গড়ে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে চলেছে। জ্ঞানের সেবা ও কল্যাণে ভিক্টোরিয়া পাবলিক লাইব্রেরি পথ চলুক অম্লান ধারায় অবিরত।

No comments

Powered by Blogger.