স্মরণ চলে গেলেন ‘রূপালী নদী রে’ গানের গীতিকার কবির বকুল

‘রূপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’—মরমি শিল্পী আবদুল আলীমের গাওয়া কালজয়ী এ গান। সত্য সাহার সুরারোপিত ষাটের দশকের তুমুল জনপ্রিয় এই গান এখনো ভেসে বেড়ায় বাংলার আকাশে-বাতাসে। গানটির রচয়িতা ছিলেন আনিসুল হক চৌধুরী। নিভৃতচারী গুণী এই গীতিকার অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। ৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গ জেনারেল হাসপাতালে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা ও বাংলাদেশ সময় ৮ সেপ্টেম্বর রাত তিনটায় মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। প্রায় ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে স্ত্রী, তিন ছেলে, নাতি-নাতনির সঙ্গে বসবাস করছিলেন তিনি।
১৯১৯ সালের ৩১ মে বিক্রমপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এম এ পাস করেন আনিসুল হক চৌধুরী।
মূলত তিনি ছিলেন একজন অধ্যাপক, কবি, গীতিকার, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তবে তাঁর লেখা গানের সঙ্গেই অধিক পরিচিত সবাই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বেতারে যেসব আধুনিক বাংলা গান প্রচারিত হতো, সেই গানগুলোর গীতিকার ছিলেন ফররুখ আহমদ, সায়ীদ সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান, আনিসুল হক চৌধুরী, আবদুল লতিফ প্রমুখ। ওই সময় আমাদের বাংলা গানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম ছিলেন আনিসুল হক চৌধুরী।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রথম দিকে যে কটি গান রচিত হয়েছে, এর মধ্যে একটি ছিল আনিসুল হক চৌধুরীর লেখা। গানটি ছিল, ‘ভাই রে ভাই, বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই’। তাঁর লেখা অন্যান্য গানের মধ্যে গণসংগীত ‘ঘুম ঘুম শুধু ঘুম পাড়ানী গান আজ নয়’, দেশাত্মবোধক গান ‘সাগর পাড়ের দেশ, আমাদের হাজার নদীর দেশ’ এখনো অনেকের হূদয় ছুঁয়ে আছে।
আনিসুল হকের লেখা ‘ময়নামতির শাড়ি দেব, গয়না দেব গায়’ গানটিও বেশির ভাগ নৃত্যশিল্পী তাঁদের নৃত্যশৈলীতে আবহ সংগীত হিসেবে ব্যবহার করেন। বেশ কটি চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হলো নদী ও নারী, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, সুখী পরিবার।
শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ, আবদুল আলীম, আব্দুল লতিফসহ প্রতিষ্ঠিত সব শিল্পীই তাঁর লেখা গান গেয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় গুণী এই গীতিকার সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বর করা মন্তব্য থেকে তাঁর গানের মানের ধারণা পাওয়া যায়।
আনিসুল হকের রচিত গান ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র কর্তৃক সমাদৃত ও সম্প্রচারিত হয়েছে।—(কবি জসীমউদ্দীন, ৩ জুন, ১৯৪৩)।
‘তাঁর রচিত কতকগুলি গান আমি গেয়েছি। অল্প কজন প্রথম শ্রেণীর গীতিকারের মধ্যে তিনি অন্যতম। (পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীন আহমদ, ২০ মে, ১৯৫৮)
‘বাংলা গানের রচয়িতা হিসেবে তিনি একটি নাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন।’—(কবি গোলাম মোস্তফা, ১৬ জুন, ১৯৪৯)।
আর গুণী এই গীতিকার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু বলেছিলেন, ‘কবি আনিসুল হক চৌধুরী সংগীতের ক্ষেত্রে আমার একজন পুরোনো বন্ধু। আমি তাঁর লেখা অনেক গান সুরারোপ করেছি এবং তা শ্রোতাদের উচ্চ প্রশংসাও লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের পর গান রচনায় যাঁরা মৌলিকতা, সাবলীলতা, আন্তরিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দাবি করতে পারেন, সেই অল্প কজন গীতিকারের মধ্যে তিনিও একজন।’ (২২ মে, ১৯৫৮)
আনিসুল হক চৌধুরী ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
আনিসুল হকের লেখা গবেষণামূলক বই বাংলার মুখ, গানের বই গানে ভরে মন এবং প্রবন্ধ নিশি ভোরের ফুল উল্লেখযোগ্য।
শেষ সময়ে প্রবাসে বসেও তিনি লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। ফ্লোরিডার স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিয়মিত ইংরেজি কবিতা লিখতেন। সম্প্রতি প্রবাসে বসেই দেশের একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এই সময়ের বাংলা গান সম্পর্কে আনিসুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘এই সময়ের বাংলা গান শুনে আরাম পাই না। কেমন যেন অন্য রকম। শুনলে মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতির মূল শিকড় থেকে আমরা যেন অনেক দূরে সরে গেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা গানের সঙ্গে আগে দেশি বাদ্যযন্ত্রের যে সংমিশ্রণ ঘটত, তা এখন হারিয়ে গেছে।’
‘রূপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ গানটির সঙ্গে তিনটি নাম জড়িয়ে ছিল। যাঁদের দুজন শিল্পী আবদুল আলীম ও সুরস্রষ্টা সত্য সাহা অনেক আগেই চলে গেছেন। বেঁচে ছিলেন শুধু গানের গীতিকার আনিসুল হক চৌধুরী। তিনিও আজ আর নেই। তবে কখনোই হারিয়ে যাবেন না তাঁরা। যখনই যেখানে এই গানটি বেজে উঠবে, তখনই উচ্চারিত হবে তাঁদের নাম। যাঁদের একজন আনিসুল হক চৌধুরী।

No comments

Powered by Blogger.