শুদ্ধি অভিযান শুদ্ধ করেনি করেছে উন্মোচন by ব্যারিস্টার রুমীন ফারহানা

আপনি যদি একটি মিথ্যা মানুষের সামনে বারবার বলতে থাকেন তাহলে মানুষ এক সময় সেটি বিশ্বাস করতে  শুরু করবে। হিটলারের প্রপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলসের বিখ্যাত উক্তিটির এ অংশটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু অনেকেই সম্ভবত জানি না ওই উক্তির দ্বিতীয় অংশটা। সেটা হলো- এবং এমনকি আপনিও একদিন সেটা বিশ্বাস করে ফেলবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে দেখলে গোয়েবলস নিজের এই তত্ত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি বিশ্বাসী হতে পারতেন না। অথবা তিনি বেঁধে দিতেন মিথ্যার একটা সীমা। বলাবাহুল্য সেরকম একটা সীমা থাকলেও সেটা এই সরকার অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে বহুগুণে। সরকারের মিথ্যা প্রপাগান্ডা এখন আর মানুষ ‘খায় না’। অনুমান করি সরকার সেটা বোঝেও। তবুও তারা করে যায়, সম্ভবত উক্তিটির দ্বিতীয় অংশটার জন্য- বারবার বলে নিজের মিথ্যা এখন সরকারি দল নিজেই বিশ্বাস করতে চাইছে সম্ভবত।
আসা যাক সাম্প্রতিক ভয়ঙ্কর মিথ্যাটির কথায়। দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে দলের ভেতরে শুদ্ধি অভিযান চালানো হচ্ছে- প্রতিদিন সরকারি দলের বড় নেতা এবং তাদের পক্ষীয় সুশীলগণ বারবার এই কথাটি আমাদের সামনে বলে যাচ্ছেন। ভোটের আগের দিন রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে ফেলে নির্বাচন শেষ করে ফেলার মতো ঘটনা ঘটিয়ে এই পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্নীতিটি যারা করেছে তারা বলছেন তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই কথা ‘খায়নি’। মানুষ সরকারের ঘোষিত শুদ্ধি অভিযানকে একটা তুচ্ছ আইওয়াশ এর বেশি কিছু মনে করেনি।
এই তথাকথিত শুদ্ধি অভিযান দলকে শুদ্ধ করার ইচ্ছে নিয়ে করাই হয়নি, তাই সেটা দলকে শুদ্ধ করার কোনো কারণই নেই। তবে এটা কতগুলো বাস্তবতা আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে যেগুলো আমরা দীর্ঘদিন থেকে জানি, এখন সেটা এভাবে উন্মোচিত হলো মাত্র। আমরা জানতাম উন্নয়নের নামে কী অবিশ্বাস্য লুটপাট চলছে এই দেশে। যুবলীগের জি কে শামীম গ্রেপ্তার হয়ে সত্য উন্মোচন করলো যুবলীগের একজন সম্পাদকের ব্যাংকে টাকাই আছে ৩০০ কোটি। আছে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ৭-৮টি বাড়ি, অনেকগুলো ফ্ল্যাট, ঢাকার আশেপাশে শত শত বিঘা জমি। বলাবাহুল্য এগুলো তার দেশে থাকা সম্পদ। প্রতি বছর এদেশ থেকে কমপক্ষে যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়, তার মধ্যেও এই ভদ্রলোকের টাকা থাকারই কথা। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম কিংবা কানাডার বেগম পাড়ায় তার সম্পত্তি যোগ করলে কত হতে পারে সেটা? ‘এবার যুবলীগের একজন সম্পাদকের সম্পদকে পদ অনুযায়ী উপযুক্ত কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে আপনি পেয়ে যেতে পারেন মূল সংগঠনের একজন নেতার সম্পদের পরিমাণ কী হতে পারে।’
একটা অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসনকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করে, তাই প্রশাসনের লুটপাটও হয়ে যায় গগনচুম্বী- এটাও আমাদের জানা ছিল। কিন্তু জনাব শামীমের ঘটনায় দেখলাম তিনি তার কাজের জন্য দুইজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাকে ঘুষই দিয়েছেন ১৫০০ কোটি টাকা। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাকেও মোটা অঙ্কের ঘুষ দেয়ার তথ্য পত্রিকায় এসেছে। আমাদের জানা তথ্যটা স্পষ্টভাবে উন্মোচিত হলো।
এটাও আমাদের অজানা ছিল, এই রাষ্ট্রের যেখানেই কোনো কাজ হোক না কেন সেখানেই আওয়ামী লীগ বা তার যেকোনো অঙ্গ অথবা সহযোগী সংগঠনের ‘ন্যায্য হিস্যা’ থাকে। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কারের আইওয়াশ দেখালেও, আমাদের সামনে উন্মোচিত হলো তারা তাদের ‘ন্যায্য পাওনা’ চেয়েছিল মাত্র।
আমরা জানতাম বিরোধীদলকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলার পর খেয়োখেয়ি নিয়ে সরকারি দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় ভিসি শোভন-রাব্বানীর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ যেমন করেছেন, তেমনি ওই দু’জন দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন উপাচার্যের বিরুদ্ধে। জাবি ছাত্রলীগকে উপাচার্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা ‘ঈদ বকশিস’ দিয়েছেন, এই কথা প্রমাণিত হয়েছে। উন্মোচিত হলো আমরা যা ভেবেছি তাই, লুটপাট নিয়ে এখন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরমে।
চট্টগ্রামের এক পুলিশ পরিদর্শক প্রকাশ্যে জানান, চট্টগ্রামের জুয়ার কেন্দ্রগুলো হতে সরকারি দলের হুইপ থেকে পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১৮০ কোটি টাকা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। শুধু সেটাও না তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরো অনেকের অবৈধ উপার্জন সম্পর্কে ধারণা দেয় আছে। আবার ওদিকে মতিঝিল থানার ওসি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় ওখানকার ক্লাব পাড়ায় বহু আগে থেকেই জুয়া চলছে। ক্ষমতা কে বেশি উপভোগ করবে, লুটপাট কে বেশি করবে, সেটা নিয়ে সরকারি দল আর পুলিশসহ প্রশাসনের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা আমরা শুনতাম। এটা এবার উন্মোচিত হলো।
ঢাকার যাবতীয় জুয়ার নিয়ন্ত্রণ যার হাতে, যিনি প্রতি মাসে ১০ দিন টাকার বস্তা নিয়ে সিঙ্গাপুরে থাকেন জুয়া খেলার জন্য, সেই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট গ্রেপ্তার হননি। নিজ কার্যালয়ে বহু নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়াকে পরাজিত করার অপেক্ষায় আছেন তিনি। এই রাষ্ট্রে বসবাস করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন তিনি। যেই রাষ্ট্রে বিচার বিভাগের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যায়, সেখানে প্রশাসন তো কিছুই না। জনাব সম্রাটের এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো এই রাষ্ট্রে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আর নেই। ও হ্যাঁ, আর সব বিষয়ের মতো এটাও জানতাম আমরা।
>>>লেখক: সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

No comments

Powered by Blogger.