কাতারে সাদামনের এক বাংলাদেশি

কাতারে সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশি মুহাম্মদ আবদুস সাত্তার। সেখানে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন এক বড় অবলম্বন। নানা সমস্যায় তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ান আবদুস সাত্তার। শুধু তাই নয়, তিনি স্থানীয় কাতারি জনগণের সঙ্গেও গড়ে তুলেছেন সখ্য। তাই বাংলাদেশি সম্প্রদায় ও কাতারের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। ৪০ বছরের বেশি এমন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আবদুস সাত্তার। বিশেষ করে কাতারে কোনো বাংলাদেশি মারা গেলে তার মৃতদেহ দেশে পাঠাতে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তার অধীনে থাকা সংগঠন ও তিনি নজির স্থাপন করেছেন। যুক্ত হয়েছেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে।
গরিব ও অসহায় ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা দেন। যেসব হতদরিদ্র পরিবার সন্তানদের পোশাক ও খাদ্য যোগাড় করতে পারে না তাদের তা দেয়াসহ তিনি নিম্ন আয়ের রোগীদের দেন ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সহায়তা। এমন উদার মনের মুহাম্মদ আবদুস সাত্তারকে নিয়ে অনলাইন গালফ নিউজ একটি ফিচার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সাংবাদিক মুদাস্‌সির রাজা লিখেছেন, তিনি ৪০ বছরের ওপরে সামাজিক ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কাছে তিনি একজন নম্র ও জ্ঞানী মানুষ হয়ে উঠেছেন। কাজের টানে তিনি কাতার গিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে পা রাখেন রাজধানী দোহায়। সেখানে কাজ করতে করতে এখন তিনি অবসরের পথে। বিদায় নেবেন তার দ্বিতীয় বাড়ি কাতার থেকে। তবে সামাজিক কর্মকাণ্ডের ওপর একটি বই লেখার বাসনা আছে তার। কিন্তু ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে ছাড়তে হচ্ছে কাতার। তিনি বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে এ সম্পর্কে বলেন, মনে হচ্ছে ৪০ বছরেরও বেশি সময় কাতারে অবস্থান করার পর আমার বাড়ি আর পরিবারের প্রিয়জনদের ছেড়ে যাচ্ছি।
প্রথম যখন কাতার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি বাংলাদেশে একটি সরকারি চাকরি করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চমৎকার একটি দিনে আমার পিতা আমাকে বললেন তিনি আমার জন্য ভিসা সংগ্রহ করেছেন এবং আমাকে কাতার যেতে হবে। কাতারে আমার প্রথম কাজ ছিল মাঠপর্যায়ে সেলস ও মার্কেটিংয়ে। বিভিন্ন সংগঠনে কাজ করেছি। এখন ৪০ বছর পরে যখন কাতার ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তখন আমার জীবনে কোনো অনুতাপ নেই। আমার একমাত্র মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে পড়াশোনা করছে।
আবদুস সাত্তার একজন উদ্দীপ্ত ও প্রতিশ্রুতিশীল সামাজিক কর্মী। স্বদেশিদের কল্যাণে তিনি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা শুরু করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমি দুর্বার যুব সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ ছাড়া আমি বাংলাদেশ এডুকেশন সোসাইটির স্পোর্টস শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। ১৯৯৮ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে। ৬ বছর এর প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছি। এর প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নেয়ার পথে আমি। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। আর দোহায় তা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে।
তিনি বলেন, যেসব সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করেছি তার বেশির ভাগই করতে পেরেছি জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের অংশ হওয়ার জন্য। এর কারণ হলো, এই সংগঠনে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী। বাংলাদেশি অভাবী অভিবাসীদের আর্থিক ও লজিস্টিক সমর্থন দেয়া ছাড়াও আমরা নিয়মিতভাবে কাতারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে নানা রকম অনুষ্ঠান আয়োজন করি। তাতে কাতারের বিভিন্ন অর্জন আমরা সেলিব্রেট করি। জালালাবাদ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ থেকে আমরা যে প্রধান সেবাটি দিয়ে থাকি তা হলো, কোনো বাংলাদেশি অভিবাসী মারা গেলে তার দেহ দেশে যথাযথ স্থানে পৌঁছে দিতে আমরা আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকি। বাংলাদেশী অভিবাসীদের জন্য আমরা আয়োজন করে যাচ্ছি নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তাতে কাতারে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
নিরভিমান, সাদামনের এই মানুষটি শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের মূল্যায়ন করেছেন, যখনই তিনি সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠনের হয়ে কাজ করেছেন। তিনি বলেছেন, এতটা বছর সামাজিক কাজের মাধ্যমে আমি যা কিছু শিখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- কিভাবে বড়দের ও সিনিয়রদের সম্মান করতে হয়, কিভাবে ছোটদের যত্ন নিতে হয়। এজন্যই সব সময় কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশি প্রতি জন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার রয়েছে আন্তরিক সম্পর্ক। কাতারে বর্তমানে বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত আশহুদ আহমেদ। তার সঙ্গে কাজ করে আমি পুলকিত বোধ করি। বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সেবার বিষয় এলেই তিনি অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতাপরায়ণ হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন সংগঠনকে তিনি মূল্যবান উপদেশ দিয়ে থাকেন।
মুহম্মদ আবদুস সাত্তার বলেন, আমি শুধু বাংলাদেশি অভিবাসীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। অন্যদের করতে এটা করতে বলার চেয়ে আমি নিজে কাজ করতে ভালোবাসি। বাংলাদেশে মেয়েদের একটি স্কুলে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। সাদাসিধে এই মানুষটি কাতারের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, কাতারের মানুষকে আমি অত্যন্ত বন্ধুত্বপরায়ণ ও সহযোগিতাকারী হিসেবে দেখতে পেয়েছি। আমাকে যে দেশ এতকিছু দিয়েছে তার কাছে আমি অনেক ঋণী। কাতারের অনেক মধুর ও মনোরম স্মৃতি বুকে ধরে নিয়ে যাবো।
কাতারে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের প্রতি তার পরামর্শ হলো, উত্তম চরিত্র দেশের জন্য সুনাম তৈরি করে। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা কাতারে বসবাস করি, তাই আমাদের উচিত এই দেশের আইন ও বিধিবিধান মেনে চলা। বিদেশি অভিবাসী হিসেবে আমাদের উচিত স্থানীয় জনগণ ও আমাদের নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী বন্ধন সৃষ্টি করা। বাংলাদেশি যুবাদের প্রতি সব সময়ই আমার উপদেশ- সামাজিক কল্যাণমূলক সংগঠনের কাছ থেকে আমাদের যেন কোনো কিছু প্রত্যাশা না করতে হয়। উল্টো অন্যদের সহায়তা করার জন্য এমন কল্যাণমূলক সংগঠনে সময় ও সেবা দেয়া উচিত। পাশাপাশি আর্থিক অনুদান দেয়াও উচিত আমাদের।
আবদুস সাত্তার বলেন, বাংলাদেশে ফেরত এসে তিনি অলস বসে থাকবেন না। তার ভাষায়, অবসরের জীবনটাকে আমি উপভোগ করতে চাই। সামাজিক কল্যাণ বিষয়ে একটি বই লেখার পরিকল্পনা আছে আমার। কাতারে বাংলাদেশি অভিবাসী সম্প্রদায় আমার পরিবার। এই পরিবারকে অবশ্যই আমি মিস করবো। মিস করবো আমার কাতারি বন্ধুদের। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাতার ছেড়ে যেতে হচ্ছে। একটি প্রিয় দেশ ও সহযোগীদের অংশ হয়ে এটা আমার কাছে এখন খুব বেদনার।

No comments

Powered by Blogger.